আজ প্রায় আট মাস হতে চললো সুমিত ও রত্নার মধ্যে প্রেমের যে প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল তার ইতি ঘটেছে।
আগের মতো আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না, মেসেজ হয় না, ফোন কল হয় না। এমনটা কেন হলো, দুজনের মধ্যে কার কারণে এতদিনের বন্ধন আলগা হলো এসময়ে তা ভাবা সম্পূর্ন অর্থহীন। তবুও আজকাল সুমিত ভাবে দোষটা হয়তো তারই । হয়তো রত্নাকে সে বুঝতে চেষ্টা করেনি। নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে। অনেকবার ভেবেছে একটা মেসেজ কিংবা একটা কল করবে। কিন্তু ওটা শুধু ভাবনাই থেকে যায়, করা আর হয়ে ওঠে না।
শেষমেশ দুদিন আগে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে WhatsApp টা খুলে একটা মেসেজ করেই ফেলেছিল সুমিত। সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল তবুও মেসেজের শেষে যে রকম একটা টিক ছিল সেই রকম একটা টিকই রইল। সুমিত বুঝলো রত্না নিশ্চই তার নম্বরটা ব্লক করে দিয়েছে।
দুদিন অপেক্ষা
করার পর আজকে সন্ধ্যায় রত্নাকে চিঠি লিখতে বসেছে সুমিত। একবিংশ শতাব্দীতে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগটা আধুনিক মানুষের কাছে এক ঝামেলা দুই আধুনিকতার সঙ্গে চলতে চলতে পিছিয়ে না পড়ার অজুহাত দেওয়া। সেই কারণে খুব দরকার না হলে ওসব চিঠি পত্র আদান প্রদানের ধার ধারেনা কেউ।
সুমিত বাধ্য হয়ে চিঠি লিখতে বসেছে। কাল রত্নার জন্মদিন। চিঠিতে বেশি কিছু লিখলো না সুমিত। প্রথমে দু একটা কথা জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর শেষে ভালো থেকো বলেই ইতি টানা হয়েছে। তারপর সুমিতের নিজের হাতে আঁকা রত্নার একটা পেনসিল স্কেচ ডাইরির ভেতর থেকে বের করে শেষ বারের মতো দেখে নেয়। এটাও পাঠাবে চিঠির মধ্যে।
দরজায় টোকা
পড়ে। দরজা খুলতে সৈকত দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। সুমিত আর সৈকত খুব ভালো বন্ধু। দুজনেই একই বিভাগের একই কলেজের ছাত্র। সব মাত্র কয়েদিন হলো গ্র্যাজুয়েশানের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
সামনের তক্তোপোস টা
তে বসতে বসতে সৈকত বলে, “কি রে কি করছিস?”
“তেমন কিছু না ওই...।”
সুমিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই সৈকতের নজর যায় বামদিকে বিছানার ওপর পড়ে থাকা চিঠিটার দিকে। সৈকত বলে, “কি রে, কাকে চিঠি লিখেছিস?
সুমিত কিছু বলে না। শুধু একটা দীর্ঘঃনিশ্বাস ফেলে।
সুমিত আর রত্নার ব্যাপারে সৈকত সমস্তটাই জানতো। এমন কি রত্নার সঙ্গেও সৈকতের ভালো পরিচয় ছিল। বিছানার ওপর থেকে রত্নার ছবিটা তুলে নিয়ে একবার দেখার পর সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই কি ওই মেয়েটাকে চিঠি পাঠাবি বলে ভেবেছিস নাকি?”
“হুম্।”
“তুই জানিস পরশু ওর বিয়ে।”
সুমিতের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। স্তব্ধ হয়ে আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, এক দৃষ্টে সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে। সৈকতের মুখে রত্নার বিয়ের কথা শুনে ওর বোধ হয় বাক রোধ হয়ে গেছে।
সৈকত সুমিতের দিকে কিছুটা সরে এসে তার হাঁটুর উপর বাম হাতটা রাখে। তারপর ডান হাতে চিঠিটা তুলে নিয়ে বলে, “ দেখ এরকম সময়ে চিঠি পাঠালে ঝামেলা হতে পারে। পাঠাস না চিঠি।”
সুমিতের চোখ ততক্ষনে ছলছল করে উঠেছে। এক ফোঁটা চোখের জল গিয়ে পড়ল মেঝের উপর। এতক্ষন সুমিত কাঠের মতো অনড় অবস্থায় বসেছিল। এখন একটু নড়েচড়ে বসে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমি তো জানতাম না
ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে।”
“এবার নিজেই ভেবে দেখ, চিঠি পাঠানো টা ঠিক হবে কি হবে না।”
চোখের জল ভালো করে মুছে নেয় সুমিত। তারপর ছবি আর চিঠিটা খামের ভেতরে রাখে। উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ডাইরির ভেতর চিঠিটা কে অন্তঃস্থ করে আবার খাটের উপর এসে বসে পড়ে। কিছুক্ষন রত্নার কথা ভাবতে থাকে আর ভাবতেই সুমিতের চোখের কোনে আবার জল জমতে শুরু করে। আবারও চোখ মুছতে মুছতে বলে, “ওকে একবার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“এখন কি আর সেটা সম্ভব, কারণ পরশু তো ওর বিয়ে। ও নিশ্চই বাড়ি থেকে বেরোবে না।” সৈকত বলে।
“কোনো রাস্তা কি নেই। শুধু একবার, শুধু এক পলক মাত্র।”
সুমিত একেবারেই ভেঙে পড়েছে দেখে সৈকতেরও মন খারাপ হয়ে যায়। সত্যি কোনো কিছু উপায় কি বার করা যায় না। সেও তো কিছু একটা উপায় বার করে বন্ধুকে সাহায্য করতে পারে নাকি। এমন সময় বন্ধুর পাশে থেকে তাকে যদি সাহায্য নাই করতে পারে তবে কিসের বন্ধু সে। সৈকত ভাবতে থাকে। এক মুহুর্ত পরেই তার মাথায় একটা দুর্দান্ত বুদ্ধি খেলে যায়। সুমিতের দিকে খানিক সরে এসে বাম হাতটা তার কাঁধে রেখে বলে, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। শোন, তোর তো ক্যামেরা রয়েছে, ভালো ছবিও তুলতে পারিস। এবার বিয়ে বাড়িতে যে ফোটোগ্রাফার আসবে তার পরিবর্তে যদি তুই চলে যাস তবে তো কেল্লাফতে। তখন এক পলক কেন, হাজার পলক, লাখ পলক দেখলেও কেউ কিছু বলবে না। এবার বল প্ল্যানটা কিরকম।”
“কিন্তু আমাকে তো চিনে ফেলবে ওখানে।”
সুমিতের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে মুখে অদ্ভূত একটা শব্দ করে সৈকত বলে, “আরে ছদ্মবেশে চলে যাবি।”
“হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে, বাট...”
“আবার কি হলো।”
“সবই ঠিক আছে কিন্তু ফোটোগ্রাফার কেন রাজি হবে আমাদের কথায়।”
হঠাৎ সৈকত দাঁড়িয়ে পড়ে হাত দুটোকে পেছনে রেখে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে গম্ভীর স্বরে বলে, “ফোটোগ্রাফার তার প্রাপ্য টাকা পাওয়ার পরেও যদি তাকে কোনো পরিশ্রম করতে না হয় তবে সে রাজি হবেই না বা কেন? বাদ দে ছাড়, ফোটোগ্রাফার কে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। এই টুকুনি কাজ যদি না করতে পারলাম তাহলে বন্ধু হলাম কিসের
জন্য।”
বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায়।
সেদিন বিকেল থেকে সুমিত তাদের পুরনো মেসেজগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে
দেখছিল। দেখতে দেখতে মাঝে মধ্যেই স্মৃতির অতল গভীরে নিজেকে নিমজ্জিত করছিল। সেই সময় হঠাৎ একটা ফোন কল আসে। রাত তখন প্রায় আটটা। নাম্বারটা দেখে সুমিত চিনতে পারে এটা রত্নার বাবার নাম্বার। সুমিত অবাক হয়ে যায়, রত্নার বাবা কেন তাকে এখন ফোন করেছে? তারপর বুঝতে পারে, ও আচ্ছা কাল তো তাকে ফটোগ্রাফার হয়ে যেতে হবে রত্নার
বিয়েতে।
হ্যালো বলে কলটা রিসিভ করতে, ওদিক থেকে কথা ভেসে আসে, “হ্যাঁ হ্যালো। কাল সকাল সকাল চলে এসো। আগে একবার বলেছি তবুও আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। কাল একদম সকাল সকাল চলে আসবে। খাওয়া দাওয়া এখানেই করবে, বুঝতে পেরেছো।”
সুমিত আনমনে বলে, “হ্যাঁ যেতে তো হবেই।”
“কিছু টাকা তোমায় অ্যাডভান্সড দিয়ে এসেছে বোধহয়, আর বাকি টাকাটা বিয়ে শেষ হতেই পেয়ে যাবে। তাই টাকা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না।”
“আচ্ছা।”
সুমিতের কণ্ঠস্বর আর আগের ফোটোগ্রাফারের কণ্ঠস্বর সম্পূর্নই আলাদা, তবুও এবিষয়ে রত্নার বাবা কিছুই বললো না দেখে সুমিত খুবই অবাক হলো। বোধ হয় মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় করতে খুবই ব্যাস্ত সেই কারণে ফোনে কে কথা বলছে না বলছে এতটা খেয়াল করেনি। যাই হোক সুমিতও বেশি মাথা ঘামালো না এ নিয়ে।
বিয়ের দিন সকালে সুমিতের তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেল। অন্য দিন হলে অনেক বেলা অব্দি বিছানায় পড়ে থাকতো সুমিত, কিন্তু আজকে ওর অনেক কাজ আছে, সেটা ও ভুলে যাবে কি করে। আজকে যে ওকে পাষাণ হৃদয় নিয়ে প্রতিটা ক্ষণ কাটাতে হবে নিজের প্রিয়তমার বিয়ের মন্ডপে। সে সবকিছু চোখের সামনে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠতেই সুমিতের কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু না, এখন ওকে যেতে হবে সেই অনেকটা রাস্তা, ছয় মাইল।
সুমিত সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। সেই পরিচিত রাস্তা, বট গাছটাকে বামে রেখে পিচের রাস্তা থেকে বামদিকের বাঁক। মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে গিয়েই সোজা আর বামদিকে দুদিকে দুটো পথ। সুমিত জানে কোন দিকে যেতে হবে, তাই সে বামদিকের রাস্তা ধরলো। এই সমস্ত পথঘাট সুমিতের ভীষণ পরিচিত। কত বার যে এই পথ ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে রত্নার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। এতটাই পরিচিত যে, যদি রাতের অন্ধকারে ওকে টর্চ বিহীন অবস্থাতেও এই রাস্তাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তবুও সুমিত অনায়াসেই ফিরতে কিংবা যেতে পারবে।
প্রায় অনেক খানি পথ যাওয়ার পর মাইকে বেজে চলা গানের শব্দ সুমিতের কানে ভেসে আসে। মাইকের শব্দ কানে আসতে সুমিতের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। শুকনো মুখ আর বাস্পায়িত চোখ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
খানিক পরে মাইকের শব্দ আরও তীব্র হয়। জমকালো রূপে সাজানো একটা গেটের সামনে হাজির হয় সুমিত। উপরের দিকে চোখ তুলে তাকায়, গেটের উপরে মাঝখানে লেখা রয়েছে শুভ বিবাহ। তার ঠিক নিচে থার্মকল দিয়ে তৈরি টকটকে লাল রঙের একটা love চিহ্ন যার একদিকে লেখা রত্না এবং অন্যদিকে অখিলেশ।
গেটের ভেতর দিয়ে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যায় সুমিত। বাম কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগ আর হাতে ধরা একটা দামি ক্যামেরা নিয়ে সুমিত হাজির হয় রত্নার বাড়ির সামনে। চারিদিকে ভীষণ ব্যস্ততা, বিয়ে বাড়িতে যা হয়ে থাকে। দুজন লোক প্যান্ডেলে কাপড় টাঙাচ্ছে, একজন বিভিন্ন রঙের ফুল ও পাতা দিয়ে প্যান্ডেলটাকে সুসজ্জিত করছে। আর একজন টিউব লাইট ও ফ্যান টাঙাচ্ছে। চারদিকে দেখতে দেখতে সুমিত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
সুমিতের কয়েকজন চেনা বন্ধু ওকে পাত্তা না দিয়ে পাস কাটিয়ে চলে যেতে সুমিত বুঝতে পারে তার ছদ্মবেশটা নিখুঁত হয়েছে। তাছাড়া ও একজন ফোটোগ্রাফার হয়ে এসেছে কেই বা তাকে পাত্তা দেবে।
একজন বৃদ্ধ গোছের লোক সুমিতকে ক্যামেরা হাতে দেখে ওর দিকে তড়িঘড়ি ছুটে এসে বলল, “আরে তুমি এসে পড়েছো। বেশ তবে তুমি ওদিকে গিয়ে কিছু খেয়ে নাও। কনে এখুনি স্নান করতে যাবে বেরোচ্ছে, গায়ে হলুদ রয়েছে, তারপর স্নান সেরে ফিরতে এগারোটা কিংবা বারোটাও বাজতে পারে। ছবি তুলতে তুলতে খাওয়ার কথাই ভুলে যাবে হয়তো তার চেয়ে বরং এখুনি খেয়ে নাও।”
সুমিত বুঝতে পারে এই বয়স্ক লোকটি নিশ্চই রত্নার দাদু। সুমিত বৃদ্ধ লোকটির বাকি কথা আটকে দিয়ে বলে, “আজ্ঞে না না আমি খেয়েই এসেছি, এখন খিদে নেই। যখন খিদে পাবে তখন না হয় খেয়ে নেওয়া যাবে।”
“দেখো যদি সময় বের করতে পারো।” বলে উনি ভেতরে চলে যান।
হাত ঘড়িটার দিকে
চোখ যায় সুমিতের। এখন বাজে সোয়া দশটা। হাতে বোধহয় কিছু সময় আছে ভেবে বাড়ির ভেতরে বিশেষ একজনকে খুঁজতে ঢুকে পড়ে সুমিত। গায়ে হলুদের সময় ছবি তুলতে গেলে রত্নাকে এমনিতেই দেখতে পেত ও। কিন্তু সে অনেক দেরি। ওর মন ছটফট করছে, এখনি এক পলক না দেখলে ও বোধহয় মরেই যাবে।
রত্নার সঙ্গে দেখা করতে আগে অনেক বার এখানে এসেছে সুমিত। কিন্তু বাড়ির ভেতরে কোনো দিনও ঢোকেনি। সবসময় আড়ালে আবডালে কিছু কথা বলেই চলে যেত। ওদের সম্পর্কটা বাড়ির কেউ জানতো না কিনা তাই এতো লুকোছাপা।
সবটাই ওর কাছে
নতুন। বাড়ির ভেতর লোকে লোকারণ্য। বড়োরা এক বাঁধা ধরা শৃঙ্খলের মধ্যে কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা গুলো শৃঙ্খলের দড়ি ছিঁড়ে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। তাদের মধ্যেই
একটা বাচ্চা মেয়েকে ডেকে সুমিত জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, কনে কোন ঘরে রয়েছে তুমি কি জানো?”
সুমিতের কথা শুনে
বাচ্চা মেয়েটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “কে কনে?”
ঠোঁটের কোণে একটা আলগা হাসি এনে ধীর কণ্ঠে সুমিত বলল, “আজকে যার বিয়ে সে কোথায় জানো?”
“ও তুমি পিসির কথা বলছো। সে তো উপরের ঘরে। যে ঘরটার সামনে লাল গোলাপের একটা টব রাখা আছে সেই ঘরটাতে।”
সুমিত মেয়েটার
কথা শুনতে শুনতে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটার হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে লাল গোলাপের ছেঁড়া পাঁপড়ির কিছু অবশিষ্টাংশ।
ঠোঁটের কোণে সেই আলগা হাসিটা রেখে সুমিত বলল, “তুমি তবে ওই গাছ থেকেই গোলাপটা ছিঁড়ে এনেছো, তাইতো।”
মেয়েটা সঙ্গে
সঙ্গে হাতটাকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ ওই গাছ থেকেই। কিন্তু তুমি প্লিজ পিসিকে কিছু বলো না। পিসি জানতে পারলে খুব রাগ করবে।”
“আচ্ছা বেশ বলবো না। যাও তুমি এবার
খেলতে যাও।”
মেয়েটা চলে
যাচ্ছিল কিন্তু সুমিতের কি মনে হতে ডেকে বলল, “আচ্ছা আরেকটু শোনো এদিকে।”
“আবার কি হলো।”
“এদিকে এসো। যাও ওখানে ওই দেওয়াল ধারে গিয়ে দাঁড়াও। তোমার একটা ছবি
তুলবো।”
“তুমি আমার ছবি তুলে পিসিকে দেখিয়ে বলবে, গোলাপ ছিঁড়েছিলাম, তাই না।”
সুমিত ক্যামেরাটা মেয়েটার দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে বিস্তর হেসে বলল, “আরে না, তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে। আমার খুব ভালো লেগেছে তোমাকে, তাই তোমার একটা ছবি তুলবো, কাউকে দেখানোর জন্য নয়।”
সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা স্বশব্দে গর্জে উঠল।
সিঁড়ি বেয়ে সুমিত উপরে উঠে এসে দেখল, বারান্দায় টবের মাটিতে একটা ঝাঁকড়া গোলাপ গাছ লাল টকটকে গোলাপ ফুলে সুসজ্জিত হয়ে রয়েছে। গাছের গোড়ায় ও টবের চারপাশে গোলাপের পাপড়িও পড়ে থাকতে দেখল সুমিত। তারপর উল্টো দিকের ঘরটার দিকে নজর গেল সুমিতের। ওখানে অনেক মেয়ে ও বউয়েরা বসে রয়েছে। সুমিত একটু আড়ালে জানালা ধারে সরে এলো। ওখান থেকে রত্নার মুখখানি বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুমিত একদৃষ্টে রত্নার দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই সুমিতের বুক ফেটে নিঃশব্দে চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। চোখের জল মুছতে মুছতে রত্নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “খুব ভালো বর হোক তোমার। সুখী হও জীবনে।”
“আরে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?”
সুমিত চমকে পেছনে ফিরে তাকালো। দেখল, রত্নার বাবা ওর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে সুমিত আমতা আমতা করে বলল, “না মানে কনের ছবি তুলতে হবে তো তাই...।”
“না না কনের ছবি পরে তুলবে। তুমি আগে যাও নিচে ওদের কয়েকজনের ছবি তুলে দেবে। না হলে মাথা খারাপ করে ছাড়বে আমার।”
“আচ্ছা ঠিক আছে যেমন টি বলবেন।”
বরের বাড়ি থেকে হলুদ তেল এলে, প্রায় পৌনে এগারোটার সময় আধ মাইল দূরে একটা পুকুর ঘাটের কাছে সবাই উপস্থিত হয়। কনের পরনে হলুদ রঙের শাড়ি, সবুজ রঙের ব্লাউজ।
খানিক পরেই কনের সারা অঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলুদের দাগ লাগলো। সুমিত এক দৃষ্টে রত্নার দিকে তাকিয়েছিল। খুব সুন্দর লাগছে ওকে হলুদ রঙের শাড়িতে। বেনারসিতে বোধ হয় আরও বেশি সুন্দর লাগবে।
কেউ একজন হঠাৎ বলে উঠল, “কি মুশকিল, এ ফোটোগ্রাফার তো ছবি না তুলে হাঁ করে শুধু কনের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আরে ছবি-টবি কিছু তুলবে নাকি
শুধু ফকটিসেই টাকা গুলো নেবে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো তুলছি।”
সুমিত ছবি তুলছিল ঠিকই কিন্তু মাঝে মধ্যেই আড় চোখে রত্নার দিকে দেখতে ভুলে যাচ্ছিল না। আবার এরই ফাঁকে সবার মনের মতো ছবি তুলে দিয়ে ঢের প্রশংসা ও অর্জন করে নিল সুমিত।
অনেকটা সময় কেটে গেছে। একটু একটু করে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে। সুমিত এখন খুবই
ক্লান্ত। তাই ও বাড়ির পেছনে ফাঁকা যায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিল একটু
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে। তার সঙ্গে ভাবছিল কিভাবে নিজেকে এই দুঃখের পাহাড় থেকে বার
করা যায়।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সুমিতের আবার হাঁক ডাক পড়ল। বরের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে ছবি
তুলতে হবে।
সুমিত গিয়ে দেখল, প্যান্ডেলের ভেতরে রাখা মস্ত সোফাতে বর গা এলিয়ে বসে রয়েছে। তার কাছাকাছি কয়েকটি কম বয়সী মেয়ে ও ছেলে বসে গল্প করছে। সুমিত ভাবলো এরা নিশ্চই সম্পর্কে বরের শালা কিংবা শালী হয়। যাই হোক ওসব জেনে তারই বা কি লাভ। তার যা কাজ সে তাই করলো, কিছু ছবি তুলে দিতে বলায় সে ছবি তুলে দিল।
বিউটি পার্লার থেকে দুটি মেয়ে কনে কে সাজাতে এসেছে। সেই বিকেল থেকে সাজতে বসেছে রত্না। সুমিত এরই মধ্যে সাতান্ন বার ওকে লুকিয়ে দেখে এসেছে সেই সঙ্গে দু বার ছবি তুলতে গিয়েও দেখেছে। এখন আর একবার যেতে সংখ্যাটা ষাটে পৌঁছালো। এতক্ষনে সাজানো শেষ হয়েছে রত্নাকে। নতুন সাজে রত্নাকে বারান্দায় ফোটা লাল গোলাপের মতোই সুন্দর লাগছে। জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সুমিতের ডান হাতখানি তার অজান্তেই উপরে উঠে এসে প্রশংসার ভঙ্গিতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী একত্র হলো। হঠাৎই চোখের কোণ বেয়ে নোনা জল গাল বেয়ে ওর পায়ের উপর গিয়ে পড়তে হুঁশ ফিরল সুমিতের। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নিচে নেমে এসে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো বাড়ির পেছনে সেই নির্জন জায়গাটাতে। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ওর চোখ আবারও জলে ভরে ওঠল। বুক ফেটে বেরিয়ে আসা একটা নিঃশব্দ কান্না ওর সারা শরীর কে কাঁপিয়ে দিল। যে কাঁন্নার হাহাকার সবার অলক্ষ্যে থেকে গেল কেউ জানতেও পারলো
না এমনকি রত্না ও নয়।
লগ্ন অনুযায়ী বিয়ে শুরু হলো। চারদিকে ব্যস্ততা, লোকজনের ভিড় আর মাইকের শব্দে মুখরিত। সুমিত তার কাজ বহাল তবিয়তে করছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই সুমিতের যেন মনে হচ্ছে ওর বুকের ভেতরটা জ্বলছে, পা গুলো টলমল করছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। চোখ গুলো মাঝে মধ্যেই যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। এত আলোর মধ্যেও ও যেন অন্ধকার দেখছে চোখে। ও জানে এমনটা হচ্ছে কেন, তাই আর বেশি মাথা ঘামলো না। নিজের কাজে মন দিল। একটু পরেই তো সমস্ত কাজ থেকে ওকে অবসর নিতে হবে।
রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। মাইকে সানাই বাজছে। পুরোহিত বিয়ের মন্ত্র পড়ছে। সুমিতের ক্যামেরাটা বিয়ের পিঁড়ির দিকে ঘোরানো রয়েছে। সেই সময় হঠাৎ সুমিতের চোখ বুজে এলো। চোখ সম্পূর্ন বন্ধ হওয়ার আগে সুমিত দেখল, রত্নার সিথিতে বর সিঁদুর দিচ্ছে। আর তারপরেই সুমিতের হাত থেকে ক্যামেরাটা মাটিতে পড়ে গেল, তার সঙ্গে পড়ল সুমিতের দেহটা।
সবাই হাঁ হয়ে দেখছে। সুমিতের দেহটা থরথর করে কয়েকবার কাঁপলো তারপর ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে গেল।
ঘটনাটা ঘটতে বোধহয় তিন সেকেন্ড সময় লাগছিল। এর মধ্যেই কয়েকজন বলিষ্ঠ যুবক তার শরীরটাকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দিল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে ডাক্তার সুমিতের শরীরটাকে কিছুক্ষন ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “He is no more.”