Subscribe Us

header ads

স্বপ্নহীনা

সুমিতার বিয়ে হয়েছে আজ মাস চারেক হল। মন ভালো নেই ওর। স্বপ্ন হীন এ মন মরা জীবনে স্বপ্ন গুলো যেন কাচ ভাঙা টুকরোর মতোই ছন্নছাড়া। বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু সুমিতার একটুও ইচ্ছে ছিল না বিয়েতে। ওর তো ইচ্ছে ছিল খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর। কিন্তু পারেনি কেন? মেয়ে বলে কি? প্রশ্নটা আজও ভাবায়।

স্বপ্ন ছিল WBCS এক্সাম ক্লিয়ার করে সরকারি কোনো এক উচ্চ পদে চাকরি করার। কিন্তু সে স্বপ্ন আজ সংসার রূপী যাঁতাকলে পিষে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। আর ইচ্ছেও হয় না এত ব্যাস্ততার মাঝে স্বপ্ন দেখতে। স্বপ্ন দেখার সময় ফুরিয়েছে এক নতুন জগতে এসে। এখন তাকে অন্যদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। আর ওতেই যত ব্যস্ততা।

Picture collected from Internet

বিকাল চারটার বেশি হয়ে গেলসুমিতা তৈরি হয়ে বসেছিলঅভিরুপ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে একসঙ্গে বেরিয়ে যাবে মামার বাড়িতেকাল ওর মামার একমাত্র ছেলের বিয়েমামা-মামী দুজনেই ধমক দিয়ে বলে দিয়েছে বিয়ের আগের দিনই যেন উপস্থিত হয়ে যায় সুমিতা আর জামাই।

খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে সুমিতা তৃতীয় বার ফোন করলো অভিরুপকে

ওদিক থেকে অভিরূপ বলল, “হ্যাঁ বলো।”

তোমার কি আরও কত দেরি হবে?

হ্যাঁ একটু দেরি হবেতুমি বরং একটা কাজ করো, স্কুটিটা নিয়ে আমার অফিসেই চলে এসোএখান থেকেই চলে যাবো।

এতটা রাস্তা...”

আরে বেশি নয়। মাত্র ৫-মাইল।”

হ্যাঁ কম হয়ে গেছেআর শোনো তুমি তো চেঞ্জ তো করবে নাকি?

হ্যাঁ সব কিছু নিয়ে চলে এসো এখানেই চেঞ্জ করে নেবো।”

উফ্ পাগল করে দেবে আমায়।

বলে সুমিতা ফোন কেটে দেয়। তারপর সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অভিরুপের অফিসের উদ্দেশ্যে


ভাদ্রের বিকেল। সূর্যাস্ত হতে আরও প্রায় দুই ঘণ্টা বাকি। সুমিতা বেরিয়েছে মিনিট পাঁচেক হলো। কিন্তু এর মধ্যেই অনেকটা পথ চলে এসেছেরাস্তা যে একদমই শুনশান তেমন টা নয়। একটু তাড়াহুড়ো সেই কারণে তাড়াতাড়ি

একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছেকিন্তু আকাশ এখন একদমই নীলাভভেজা রাস্তার উপর দিয়ে নিজের সুবিধা মতো পথ বেছে নিয়ে সুমিতা চলছেঝড়ের মতো হাওয়া এসে ওর চোখে মুখে লাগছে। হেলমেটের বাইরে বেরিয়ে থাকা চুল গুলো হাওয়ার তাড়নায় পেছনের দিকে উড়ছেআজকের আবহাওয়া টা খুবই সুন্দর সেই কারণে সুমিতার শুকনো মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল

প্রায় তিন মাইল মতো পথ চলে এসেছে এমন সময় সুমিতা একটা বাইককে ওর সামনে আসতে দেখলএর আগেও অনেক বাইককে সুমিতা ওর সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখেছেকিন্তু এই বাইক আরোহী বছর চল্লিশের এক ভদ্র লোক সুমিতার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আসছে দেখে সুমিতা খুবই অবাক হলো। তবে কি লোকটা তাকে চেনেসুমিতাও লোকটার দিকে নজর দিল। নীল রঙের শার্ট, কালো রঙের প্যান্ট, মাথায় হেলমেট পরিহিত লোকটাকে ভালো করে দেখতেই কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল সুমিতারকিন্তু কে হতে পারে সেটা এত দূর থেকে ঠাওর করতে পারলো না সে।

বাইকটা সুমিতার স্কুটির কাছাকাছি আসতেই সুমিতা চিনতে পারলো লোকটাকেএনি তো তাদের স্কুলের বিভূতি স্যার। সুমিতা দেখলো স্যারও ওকে চিনতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেসুমিতার একবার মনে হলো দাঁড়াবে কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়লো ছয় মাস আগের কথা। কথাটা মনে পড়তে সুমিতার নিজের খুব খারাপ লাগলোকোন মুখে সে স্যারের সামনে দাঁড়াবেতাই সে আর দাঁড়ালো না। কিন্তু সুমিতা যখন একটু দূরে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলো, স্যারও পেছন ফিরে ওর দিকেই তাকিয়েছে তখন সুমিতা না দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না

স্যারও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেনসুমিতা স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, স্যার বললেন,সুমিতা না?”

হ্যাঁ স্যার, কেমন আছেন?” বলেই ঠক করে একটা প্রণাম সেরে ফেলল সুমিতা

আরে থাক থাক আমি ভালো আছিতুই কেমন আছিস বল।

ভালো।সুমিতা আর কিছু বলল না

স্যার বললেন, “তুই কবে এরকম হুটহাট করে বিয়ে করে নিয়েছিস জানতাম না তোআমি যত দুর জানতাম তুই আর তনুশ্রী দুজনে মিলে WBCS এর জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলিস।”

হ্যাঁ ও পরীক্ষা দিয়েছে।কথাটা বলেই সুমিতা স্যারের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল

কিন্তু তোর কি হলো? তুই নিজেই তো আমায় আজ মাস ছয়েক আগেই বলেছিলি সরকারি কোনো উচ্চ পদে চাকরি করবিআর সেই মতো করে তো WBCS এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলি। কিন্তু তারপর কী এমন হলো যে বিয়ে করে নিলি

সুমিতা আমতা আমতা করে বলল, “তেমন কিছু নয় বাড়িতে বলল তাই বিয়ে করে নিয়েছি

আমি যতদূর জানি তুই খুব জেদি মেয়ে বাড়ির কারুর এক কথায় তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাবি সেটা অবিশ্বাস্য আসলে কি হয়েছিল বল দেখিনি আমায় খোলসা করে

তেমন কিছু নয় স্যার।

বেশি কথা বাড়াস না চল ওখানে বসবি। তারপর সব কথা শুনবো তার আগে স্কুটি টা কে এক সাইড করে রাখ।

সুমিতা স্যারের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতো স্কুটি টা কে রাস্তার এক ধারে রাখল তারপর স্যার যেখানটায় গিয়ে বসেছিলেন সেখানে গিয়ে বসল


এটা কোনো বড়ো হাইওয়ে বা ওইরকম কোনো রাস্তা নয়। একটা মাত্র সিঙ্গেল পিচের  রাস্তা দুটিকে সারি সারি সদ্য লাগানো আকাশমণি গাছ লম্বায় মাথা ছুঁয়েছে আর তারই কিছুটা সবুজহীন জায়গায় রয়েছে ছোটো একটা ব্রিজব্রিজ টা তেমন আহামরি কিছু নয়। বসবার জন্য দুদিকে বেশ অনেকটা করে জায়গা রয়েছে বিকেলে লোকজন এখানে আড্ডা দিতে আসে। এখনো পর্যন্ত তেমন কেউ এসে পৌঁছায়নি। তাই বসবার জায়গা গুলো পুরোপুরি ফাঁকা

স্যার নিজের চশমাটা নাকের উপর ঠিক করে বসিয়ে নিয়ে সুমিতার উদ্দেশ্যে বলল,বল এবার। বাড়িতে কি খুবই চাপ দিচ্ছিল বিয়ের জন্য যে বিয়ে করে নিলি তা ও আবার নিজের স্বপ্নের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে

সুমিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর ধীর গলায় বলল, “কি করবো স্যার বাধ্য হয়েছি ভুলে যাওয়ার

যদি বিয়েই করে ফেলবি তবে কি দরকার ছিল এত সব স্বপ্ন দেখার

সুমিতা একখানি ব্যার্থতার নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ওটাই ভুল করেছিলাম। মিছেই স্বপ্ন গুলো দেখেছিলাম ছোটো বেলা থেকে ভেবেছিলাম কিছু একটা চাকরি করবো। নিজের পায়ে দাঁড়াব মা বাবার একমাত্র মেয়ে আমি। ভেবেছিলাম বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের দেখা শোনা করবো। কিন্তু আমার তো এখন কোনো সামর্থ্যই নেই।

কথাটা বলতে বলতে সুমিতার চোখে জল চলে এল স্যার এক দৃষ্টে সুমিতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখ দুটো মুছে নিয়ে সুমিতা কিছুক্ষণ দূরে আকাশের পানে চুপ করে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগল, “আসলে কি জানেন স্যার আমরা মেয়ে আর মেয়েদেরকে ছেলেদের মতো এত সময় দেওয়া হয় না স্বপ্ন পূরণের জন্য পড়াশোনা চলাকালীন বাড়ির লোকজন, আত্মীয় স্বজন সবাই বলবে মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়ে গেল, বিয়ে দিয়ে দাও এবার তারা নিজে থেকেই মেয়ের বিয়ের বয়স বেঁধে দেয়, হয় স্কুল পাশ নয়তো টেনেটুনে কলেজ তারা ভুলেই যায় যে তাদের মেয়ের একটা ইচ্ছে আছে, একটা স্বপ্ন আছে খোঁজ নিয়ে দেখবেন স্যার, যে সমস্ত মেয়েদের জীবনে সাফল্য এসেছে তার পেছনে তার বাবা মায়ের কতটা সাপোর্ট ছিল। আর আমাদের মতো মেয়েদের বাড়িতে মেয়েকে কখন বিয়ে দিয়ে বিদায় করে সেই চিন্তায় রয়েছে সবাই।”

স্যার দেখলেন সুমিতা একটু রেগে গিয়েছে। বললেন, “সব বাবা-মায়েরাই চায় তার সন্তানরা যাতে ভালো থাকে।

সুমিতা স্যারের কথার প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলল না

স্যার আরও কিছু একটা বলতে যাবে সেই সময় তাঁর মোবাইলটা বেজে উঠলো পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখলেন তনুশ্রী ফোন করেছে

স্যার কলটা রিসিভ করে লাউস্পিকারে দিয়ে বললেন,হ্যাঁ বল

ওদিক থেকে তনুশ্রী বলল,স্যার ইন্টারভিউ তে পাশ করে গেছি। কাল থেকেই joining.”

“Congratulations”

“Thank you স্যার সবই স্যার আপনার জন্যই হয়েছে আপনি যদি সেদিন আমার বাপি কে বুঝিয়ে না বলতেন তবে আজকে আমার বিয়ের এক বছর হয়ে যেত

স্যার মনে মনে একটু হাসলেন। তারপর মুখ তুলে সুমিতার দিকে তাকালেন সুমিতা প্রথম থেকেই স্যারের মোবাইলের দিকে তাকিয়েছিল

তনুশ্রী বলল, “বাপি মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে বেরিয়েছে আমি জিজ্ঞাসা করতে বলল আপনার সঙ্গে নাকি কিছু দরকার আছে

কথা বলতে বলতে স্যার দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলেন। একজন চেনা মুখ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে বললেন,হ্যাঁ আসছে মনে হয়।

ঠিক আছে স্যার আপনি তবে বাপির সঙ্গে কথা বলুন। আমি এখন রাখছি

আচ্ছা ঠিক আছে, রাখ।


স্যার মোবাইলটা পকেটে ভরে রাখছিলেন ততক্ষনে তনুশ্রীর বাবা দিনাঞ্জন বাবু স্যারের সামনে হাজির হলেন হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট আর মুখে গৌরবের হাসি। কাছে আসতে স্যার বললেন,কি দিনাঞ্জন বাবু মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন বলেছিলেন যে দেখলেন তো মেয়ে আপনার কি করে দেখালো

দিনাঞ্জন বাবু স্যারের কাছে বসে পড়ে বললেন, হ্যাঁ স্যার তা আপনি যা বলেছেন। গর্বে তো আমার বুক ফেটে যাচ্ছে বিয়ে দিয়ে দিলে কি আর এটা অনুভব করতে পারতাম। এখন মনে হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়েই ছেলের অসম্পূর্ণতা মিটিয়েছেসে যাই হোক স্যার, এই খুশির দিনে আপনাকে মিষ্টি মুখ না করিয়ে ছাড়ছি নাবলেই দিনাঞ্জন বাবু মিষ্টির প্যাকেট খুলে একটা রসগোল্লা বের করে নিজের হাতে স্যারকে খাইয়ে দিলেন

তারপর আচমকাই যেন সুমিতার দিকে দিনাঞ্জন বাবুর নজর গেল। শাঁখা সিঁদুর পরা সুমিতাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,আরে সুমিতা তুই কবে বিয়ে করে নিলি? তনুশ্রী বলছিল তুই নাকি চাকরি করবি।

সুমিতা কোনো কথা বলল না চুপ চাপ বসে রইল।

আচ্ছা হোক ছাড় ওসব কথা এই নে বান্ধবীর চাকরীর খুশিতে একটু মিষ্টি মুখ করে নে।বলে মিষ্টির প্যাকেটটা সুমিতার দিকে এগিয়ে দিলেন

সুমিতা এতক্ষন চুপ চাপ বসেছিল। হঠাৎ তড়াখ করে উঠে পড়ে বলল,স্যার আমি আসি এখন। কারণ তনুশ্রীই তো কেবল আপনার স্টুডেন্ট, আমি তো কেউ নইবলে তৎক্ষণাৎ স্কুটিতে চেপে দূরে অদৃশ্য হল

সুমিতার এমনতর আচরণে স্যার তেমন অবাক না হলেও দিনাঞ্জন বাবু আশ্চর্য্য হয়ে বললেনকি হয়েছে স্যার ওর। অমন আচরণ করে চলে গেল যে।”

স্যার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঝোলানো পা দুটোর হাঁটুর কাছে আলতো চাপড় মেরে বললেন, আপনার মেয়ের মতো ওর যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি আপনার মেয়ের মতো সে তার বাবার গর্ব হতে পারেনি সেই জন্যই এত অভিমান।

তারপর আবারও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব স্বল্প স্বরে বললেন, “কিন্তু সুমিতা তুই যদি জানতিস যে তোর বাবাকেও আমি বলেছিলাম তোর ব্যাপারে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুই না ভেবে তোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন, তবে তুই আমার উপর ওভাবে রাগতিস না।”


বিকেলের পড়ন্ত আলো মুছে ফেলে চারিদিকটা কালো চাদরের আস্তরণে মুড়েছে দিনাঞ্জন বাবু গিয়েছেন অনেকক্ষণ হয়েছে স্যারের বাইকটা বিকেল থেকে যেখানটায় দাঁড় করানো ছিল ঠিক সেইখানেই একই ভাবে দাঁড় করানো রয়েছে শুধু সন্ধ্যার অন্ধকারে কালো রঙের বাইকটা তাড়াতাড়ি আবছা হয়ে গিয়েছে

রাস্তা দিয়ে কত লোকজনের যাতায়াত হয়েছে তার হিসেব নেই কত লোকজন আড্ডা মারতে এসে বাড়ি ফিরে গিয়েছে তারও হিসেব নেই শুধু স্যার যেখানটায় বসেছিলেন আগে, ঠিক সেখানটাতেই ঠায় বসে রয়েছেন ভাবছেন সুমিতার কথা। সুমিতার মতো আরও অনেক মেয়ের কথা। যাদের স্বপ্ন গুলো পূরণ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিয়ে নামক একটি শব্দ।