বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। দুঃসংবাদটা প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই শুনছি। এর আগে কত গুলো ঝড়ের সাক্ষী হয়ে রয়েছি তা হিসেব করিনি। পরে হিসেব করলে এক যোগ করে দেবো।
ইন্টারনেটে
একটা আর্টিকেলে ঝড়ের দিনক্ষণ দেখেছিলাম, সেই এক সপ্তাহ আগে। তারপর দেখতে দেখতে
ছটা দিন কেটে গেল। কলেজে পড়াশোনার চাপে ভুলেই গেলাম ঝড়ের ব্যাপারটা।
আজ
সোমবার। অন্তিম বৈশাখের উত্তাপে অর্ধেক ঘেমে নেয়ে দুপুর দুটোর সময় কলেজ থেকে
মেসে ফিরলাম। অসহ্য গরম। হাত মুখ ধুয়ে ভেজা গামছাটা গায়ে বুলিয়ে ফ্যানের
স্পিডটা সর্বোচ্চ করে পেট চাপড়ে শুয়ে পড়লাম। একসময় চোখ বুজে এল, তারপর আর কিছু
মনে নেই।
ঘুম
ভাঙ্গল সমাপনের ডাকে। সমাপন মাস দুয়েক হলো মেসে নতুন এসেছে। খুব মিশুকে ছেলে। আমাদের
কলেজে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। রঙ্গন আমি ও সমাপন একই ব্যাচ, সেকেন্ড ইয়ার।
ওর
হাঁক ডাকে আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। ফ্যানটা আগের মতোই ঘুরছে। মোবাইলে সময় দেখে
বাইরে তাকাতে অবাক হলাম। পাঁচটাও বাজেনি, এর মধ্যেই বাইরে এত আঁধার ঘনালো কোথা
থেকে! ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করে দরজার দিকে যেতে যেতে সমাপনের উদ্দেশ্যে বললাম, “কি
হয়েছে বল। আর বাইরে এত অন্ধকার, মেঘ নাকি।”
সমাপন
একটা হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে
বাইরে দাঁড়িয়েছিল। আমায় দেখতে পেয়ে পশ্চিম আকাশে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “দেখ
কিরকম কালো মেঘ উঠেছে।” হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের উদ্যেশ্যে বলল, “হে
ভগবান, একটু বৃষ্টি দাও এ গরম থেকে নিস্তার পাই।”
আমি
ওর কাছে গিয়ে পশ্চিম আকাশে তাকাতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। সত্যি এক দানবীয় কালো
মেঘমালা পশ্চিমের আকাশ ঠেলে উপরে উঠছে। দেখতে না দেখতেই মুহূর্তের মধ্যে সেই কালো
দানব পুবের নীল আকাশেও তার প্রভাব বিস্তার করলো। পরমুহুর্তেই শুরু হলো প্রচন্ড
ঝড়। যত রাজ্যের ধুলোবালি এসে নাকে, চোখে, মুখে ঢুকে একাকার হলো। দড়িতে, জানি না
কার জামাকাপড় গামছা গেঞ্জি শুকোতে দেওয়া ছিল। সমাপন সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুমে
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে একটা ভারী টিনের চালা এসে দড়িটার উপর পড়ল। সঙ্গে
সঙ্গে দড়িটা দুটুকরো হয়ে ভূমি স্পর্শ করল। ভাগ্যিস সমাপন এক সেকেন্ড আগেই সরে
গিয়েছিল, তা না হলে আজ যে কী ঘটতো তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।
রঙ্গন
এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি। যদিও ওর কাছে ছাতা আছে, কিন্তু তা দিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে
মোকাবিলা করা গেলেও ঝড়ের কাছে অসহায়। ঝড় আরো শক্তি বাড়াল। দূরে নারকেল গাছটাকে
বোধহয় উপড়ে নিয়ে যাবে। কাটা দড়ির এক দিকটা যে কলকে গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল তা
ক্রমশ চক্রাকারে মাথা দোলাচ্ছে। গাছের সবুজ টসটসে ফলগুলো হাওয়ার দাপটে যত্রতত্র ছিটকে
যাচ্ছে। ঠিক এই সময় রঙ্গন দৌড়ে এসে রুমের মধ্যে ঢুকল। হাতে নীল রঙের ছাতাটা ধরা।
ছাতাটা গোছাতে গোছাতে বলল, “বেঁচে গেছি বুঝলি তো। রাস্তায় আসতে আসতে দেখলাম, একজন
লোক মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। বোধহয় মাথায় কিছু পড়েছিল।”
দড়িটা
যেখানে টাঙানো ছিল সেদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে আমি বললাম, “এখানেও হয়েছে ওরম কিছু। ওই
দেখ টিন পড়ে দড়ি কেটে গেছে।”
“কোনো
দুর্ঘটনা ঘটেনি তো! মানে কারুর কিছু হয়নি তো।”
সমাপন
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। বলল, “আমার আজকে
অবস্থা করুণ হয়ে যেত। এক সেকেন্ডের জন্য রেহাই পেয়ে গেছি। না হলে হয়তো কাল কলেজ
ছুটি থাকতো। যাক গে এবার বোধহয় বৃষ্টি শুরু হবে বুঝলি।”
তাই
হলো। কড়াৎ শব্দ করে বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। লোডশেডিং অনেক আগেই
হয়েছিল। সবাই এসে আমাদের রুমটাতে বসলাম। বাইরে অন্ধকার, ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার।
আমরা তিনজন মিলে গল্প জুড়ে দিলাম। এটা ওটা সেটা নিয়ে গল্প করার পর একসময় আমি
বললাম, “বৃষ্টির দিন চারদিক অন্ধকার, এই অবস্থায় ভুতের গল্প করলে কেমন হয়।”
সমাপন
উৎসাহিত হয়ে বলল, “ভূতের কথাই যখন উঠল তবে কোনো অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার অভিজ্ঞতা
থাকলে বল। আমি কিন্তু এরকম এক ঘটনার সাক্ষী আছি।”
“আমার
সঙ্গে যেটা ঘটেছিল সেটা ঠিক অতিপ্রাকৃতিক নয়। কিন্তু সেরকম ঘটনার অভিজ্ঞতা কমবেশি
সবার আছে।”
“আমাদের
বাড়িতেও একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমার ঠাকুমা...।”
“থাম
থাম আমারটা আগে বলে নিই, বেশি বড়ো নয় ছোট ঘটনা।” পাচ্ছে রঙ্গন বলা শুরু করে
দেয়, তাই আমি তড়িঘড়ি নিজের কাহিনী শুরু করলাম।
“তখন
আমি স্কুলে পড়ি, ক্লাস সেভেন। মামাবাড়িতে থাকতাম। রাতে আমি আর আমার মামার ছেলে,
তার বয়স কত হবে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক কম, দুজনে একসঙ্গে শুতাম। ওটা বোধহয়
পূর্ণিমার রাত ছিল। রাত যখন মধ্যবর্তী, হঠাৎ আমার ইয়ে মানে ছোটো বাইরে পায়। একা
একা যেতে একটু ভয় করছিল। পাশে রাজু শুয়েছিল তাকে ডাকলাম। একবার দুবার তিনবার,
কোনো সাড়া না পেয়ে একবার ঠেলা দিলাম। তাতেও যখন কোনো কাজ হলো না, আমি একা একাই
বাইরে বেরিয়ে এলাম।
পূর্নিমার
রাত। ধবধবে সাদা চাঁদ চারিদিকে জোৎস্না ছড়াচ্ছে। মামার বাড়ি থেকে কিছু দূরে
রাজবাড়ীর ঝাকড়া বটগাছটা স্পষ্ট দেখা যায়। ওদিকে তাকাতেই গা টা শিউরে উঠল। মনে হতে লাগলো ওই গাছের মগডালে কারা
যেন বসে আছে। আমি ভয়ের কারণে বেশি দূরে গেলাম না। হাতের টর্চটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে
একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হলাম। টর্চটা নিভিয়ে কাজটা শুরু করতে যাবো ঠিক সেই
মুহূর্তে সামনের একটা বস্তুতে চোখ পড়ল। দিনের বেলায় যে জায়গায় বসবার জন্য
বাঁশের মাঁচা তৈরি করেছিলাম, সেই জায়গায় সাদা কাপড় পরে কেউ যেন বসে আছে। কাজ
সারা হলো না, মুখ থেকে কোনো কথা বেরালো না। শুধু ঘনঘন বুক ঢিপ ঢিপ। মনে হলো
হৃৎপিণ্ডটা বোধহয় ফেটে যাবে। তারপর পেছন ঘুরে সেই যে দৌড় লাগালাম একদম বিছানার
কাছে এসে থামলাম। বার বার মনে হতে লাগলো পেছনে বোধহয় ওটা আসছে, ওটা আসছে আমায়
ধরতে।
সকালে
বিছানায় বসে রাজুকে রাতের ঘটনাটা বললাম। রাজু শুনে ভয় পেল। দরজা খুলে মাঁচার
কাছে এসে দাঁড়াতে আমি বোকা বনে গেলাম।
রাজু
হি হি করে হেসে বলল - অঙ্কুদা ওটা তো একটা সাদা
বস্তা গো।”
সমাপন
ও রঙ্গন দুজনেই দমফাটা হাসি থামিয়ে একে একে বলল, “এরকম তো আমার সঙ্গে অনেকবার হয়েছে।
আমার সঙ্গেও।”
“আমি
আগেই বলেছিলাম যে এরকম অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই আছে। তাই তো বলছিলাম ছোটো ঘটনা আগে
বলে নিই। আচ্ছা রঙ্গন তুই কী বলছিলি, তোর ঠাকুমা না কী একটা...।”
“হ্যাঁ...।”
বলে শুরু করতে যাবে ঠিক সেই সময় তীব্র উজ্জ্বল আলো ঘরের গাঢ় অন্ধকারকে খানিকটা
শুষে নিল। তারপর কাছে কোথাও একটা কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়ল। গুরুগম্ভীর শব্দটা
গুড়গুড় করে ক্ষীণ হওয়ার পর, বাতাস ও বৃষ্টির শব্দ কানে আসতে রঙ্গন বলল, “তখন
ঠাকুমা মারা গিয়েছিল। এবার হিন্দু রীতি অনুযায়ী যা হয়, বারো দিন অশৌচ পালন করে
শ্রাদ্ধ-শান্তির পর পিণ্ডদান। ছোটোবেলা থেকেই বড়োদের কাছে একটা কথা শুনতাম,
মৃত্যুর পর পিণ্ডদান দেওয়া না অব্দি মৃত ব্যাক্তির আত্মা নাকি বাড়ির চারপাশে
ঘোরাঘুরি করে। যদিও ঠাকুমা আমায় খুব স্নেহ করতো তবুও মন থেকে ভয়টা পুরোপুরি উবে
গেল না। সারাক্ষণই মনে হতে লাগলো, এই বোধহয় ঠাকুমা পেছন থেকে কাঁধে হাত দিল, এই
বোধহয় বিছানায় আমার পাশে শুয়ে আছে, এই বোধহয় অন্ধকারে সাদা কাপড় পরে সামনে
অকস্মাৎ আবির্ভূত হলো। সন্ধ্যা হলে একা একা ভয়ে কোথাও বেরোতাম না।”
“তোর
বয়স কত ছিল তখন।” সমাপন বলল।
“বয়স
তখন কত হবে...,ওই দশ এগারো মতো। ফাইভে পড়তাম।”
কেউ
মারা গেলে বাড়ির ছোটরা যেমন বেশি কষ্ট পায় তেমনি তাদের অপরিপক্ক তরুণ মনে নানান
ভীতি মূলক কল্পনা এসে ভীড় করে। বয়স বাড়লে ভয়টা কমলেও প্রিয়জন হারানোর কষ্ট
গুলো প্রায় একই রকম থেকে যায়। কথা গুলো ভাবতেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
সেই বারো বছর বয়সে মাকে হারানো। জন্মদিনে দেওয়া উপহার। মায়ের দেওয়া প্রতিটা
উপহার আমার কাছে শত হীরক খনির চেয়েও মূল্যবান। ভালবাসার চিহ্ন যে কখনো মূল্য
দিয়ে বিচার করা যায় না সেটা মাকে হারানোর পর বুঝেছি। মাথার কাছে রাখা মায়ের
ছবিটার দিকে চোখ যেতেই দুচোখ জলে ভরে গেল। এই সময় হঠাৎ একদমকা ঠান্ডা হাওয়া এসে
গায়ে লাগাতে ছবি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ মুছলাম। এই অন্ধকারে আশাকরি ওরা দুজন এটা
লক্ষ্য করেনি।
“তো
তেরো দিনের দিন সমস্ত নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধের কাজ শুরু হলো। সে সব নিয়ম-কানুন আমি
অতশত জানিনা। কিন্তু একটা সময় দেখলাম সবাইকে একটা ঘরে ডাকা হলো। যে ঘরে ঠাকুমা
থাকত। অন্ধকার ঘর। আলো জ্বালানো নিষেধ। তারই মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে দেখলাম, মেঝেতে
বৃত্তাকারে বালি সাজানো হয়েছে। চারপাশে সবাই গোল করে দাঁড়াচ্ছে। কী হচ্ছে কিছুই
বুঝতে না পেরে ছোটকা কে জিজ্ঞেস করে জানলাম, মুক্তির আগে ঠাকুমা নাকি পায়ের ছাপ
ছেড়ে যাবেন। একথা শুনে আমার বুকটা ঢিপ করে উঠল। ঠাকুমার শরীর দাহ করা হয়েছে আজ
বারো দিন হলো। যেখানে ঠাকুমারই অস্তিত্ব নেই সেখানে বালির উপর পায়ের ছাপ কীভাবে
পড়বে।
ভাবতে
ভাবতে সবার মতো হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ খুলে আশ্চর্য্য হলাম।”
“কী
দেখলি পায়ের ছাপ ?” সঙ্গে সঙ্গে সমাপন প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ
পায়ের ছাপ, স্পষ্ট। আমি তো ভয়ে দাঁড়াতেই পারছিলাম না।”
আমি
চুপটি ছিলাম। সমাপন বলল, “দেখ কেউ হয়তো ভুল করে বালি মাড়িয়ে গিয়েছিল।”
“না,
কেউ মাড়ায়নি। সবাই শিকার করেছিল।”
“আমার
তো বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই হয় এরকম।” আমি বললাম।
এই
সময় দত্ত দা মোবাইলের আলো জ্বেলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। খাটের একদিকে বসে আলো
নিভিয়ে বলল, “কি ভাই, লোডশেডিং হতেই পড়া বন্ধ করে আড্ডা জমে গেছে নাকি।”
সমাপন
ছোট্ট হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ ভুত নিয়ে কথা হচ্ছে।”
“তোমার
কোনো অভিজ্ঞতা আছে নাকি দত্ত দা ?” আমি বললাম।
দত্ত
দা অভিজ্ঞের মতো ভেবে বলল, “হ্যাঁ সে তো আছে, কিন্তু বিশ্বাস করবি কিনা ভাবছি।”
সবাই
একসঙ্গে বলে উঠলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ বিশ্বাস করবো, তুমি বলোই না।”
দত্ত
দা, পুরো নাম বিপ্রদিপ্ত দত্ত। ওর মতো লুচ্চা ছেলে আমি জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি।
ওর প্রতি পাঁচটা কথার চারটা কথাই যে নারী বিষয়ক হবে সেটা চোখ বন্ধ করে বলা যায়।
“শোন
তবে।” মোবাইলটা খাটের উপর রেখে শুরু হলো দত্তদার ভূতের কাহিনী।
“তখন
আমার ব্রেক আপ হয়েছে। খুব মন্ কষ্টে আছি। দু বার গাঁজা, একটা বোতল আর এক প্যাকেট
বিড়ি শেষ করেও যখন কাজ হলো না, তখন টলতে টলতে সন্ধায় বেরিয়ে পড়লাম আরও কিছু
মালকড়ি আনতে। কিছু দূর যেতেই ঘুমে চোখ বুজে এল। সামনে শ্মশান ছিল গিয়ে শুয়ে
পড়লাম।”
অন্ধকারে
তিনজন হেসে উঠলাম, “আর কোথাও জায়গা পেলে না, একদম শ্মশানে ?” কথাটা বলা হল ঠিকই,
কিন্তু এই অন্ধকারে শ্মশান কথাটা শুনে একটু গা-ছমছম
করছিল।
“আর
বলিস না। যখন বেরিয়েছিলাম সবে সন্ধ্যে নামছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তবুও থামছি না।
দু প্যাকেট গাঁজা একটা মালের বোতল কিনতেই হবে। রাস্তায় সাপের মতো এঁকেবেঁকে
হাঁটছি। হঠাৎ সামনে থেকে প্রচুর আলো এসে চোখে পড়ল। সেই সঙ্গে কিসের তীব্র
প্যানপ্যানানি শব্দ। পরে বুঝেছিলাম ওটা একটা লরির হর্ণের শব্দ ছিল। শব্দটা আরো
জোরালো হতে খুব বিরক্ত হলাম। চোখ দুটো বড় বড় করে একটা পাথর কুড়িয়ে মারতে
গেলাম। কিন্তু তার আগেই অন্য একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে বামদিকের ঢালু জঙ্গলের মধ্যে
গড়িয়ে গড়িয়ে শ্মশানে গিয়ে থামলাম। তারপর অঘোরে ঘুম।”
“এবার
বোধ হয় ভূত বেরাবে।” রঙ্গন বলল।
আমি
বললাম, “তোমার ভাগ্য ভালো যে রাস্তার উপর না পড়ে এক ধারে গড়িয়ে পড়েছিলে।”
“ভাগ্য
আর ভালো কোথায় রে, ভাগ্য তো এবার ভালো হবে।”
মনে
মনে ভাবলাম – যাঃ বাবা এটা কিরকম কথা হলো। মৃত্যুর
হাত থেকে বেঁচে ফেরার চেয়েও ভালো কিছু হতে পারে নাকি। কথাটা শুনে আমার কেমন মনে
হলো। সত্যি কি কোনো ভুতের ঘটনা শোনাতে চায় নাকি শেষ অব্দি লুচ্চামি জুড়বে। যাক
গে শোনা যাক। বেশি কিছু উল্টো পাল্টা বললে তিন জন মিলে রুম থেকে তাড়িয়ে দেবো।
“ঘুম
ভাঙতে অনুভব করলাম শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই বরং এক অনির্বচনীয় সুখ অনুভব করছি। কি
বলব তোদের ভাই।
তিনজনই
বুঝতে পারলাম এবার ওর বিশেষ প্রতিভা প্রকাশ পাচ্ছে। এইক্ষণে ঠেকাতে হবে।
“মনে
হতে লাগল...।”
“থাক
থাক এই অব্দি থাক। আর নয়।” বলে সমাপন থামিয়ে দিল।
দত্তদা
দুঃখিত স্বরে বলল, “শুনবি না আর। আর একটু শোন।”
“না
না এই অব্দি থাক, পরে কোনো একদিন শুনবো।” আমি বললাম।
“আচ্ছা!
শুনবি না যখন বলছিস কি আর করা যাবে, উঠি তবে।”
আমরা
আর কিছু বললাম না। দত্তদা বেরিয়ে গেল। এবার সমাপনের কাহিনী শুনতে হবে। বাইরে
বৃষ্টি পড়ছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উচ্চ স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “দত্তদা বৃষ্টি
কি থেমে গেছে ?”
“হ্যাঁ
থেমে গেছে। কিন্তু
আকাশ এখনো কালো হয়ে আছে,
আবার যে কোনো সময়ে বৃষ্টি আসতে পারে।”
কিছুক্ষণ
বৃষ্টি এল না ঠিকই কিন্তু সমাপনের কাহিনী শুরু হতেই কারেন্ট চলে এল। কারেন্ট আসতেই
মোবাইলে চার্জ দেওয়ার কথা মনে পড়ল। রঙ্গনকে দেখলাম ওর ল্যাপটপ বের করতে। সমাপন
ওর রুমে দৌড়ে গেল। রঙ্গন দেখে বলল, “কি রে তোর ভুতের গল্প শোনাবি যে।”
“আসছি,
এক মিনিট।”
এক
মিনিট পর এসে বলল, “পড়াশোনা করতে হবে, তাই সংক্ষেপে বলছি শোন।
তখন
বড়দির বিয়ে হয়নি। আমার বাচ্চা বয়স, সবে ক্লাস ফোরে উঠেছি। পুরনো মাটির ঘর
আমাদের। ছাদে বড়দির ঘরে আমি আর বড়দি বসে আছি। বড়দি আমায় অঙ্ক বোঝাচ্ছে হঠাৎ
ঘরের দরজা আপনাতেই বন্ধ হয়ে গেল। কোথাও কোনো হাওয়া চলছে না এমনকি ঘরের বিশেষ অবস্থান
হেতু হাওয়া প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও দেখলাম দরজা আপনা আপনি খুলে গেল।
আমি এক লাফে বড়দির কোলে। ভাই বোন দুজন কাঁপতে কাঁপতে মাকে ডাকতে লাগলাম। নিচ থেকে
মা আর ছোটদি দৌড়ে এল ছাদে। সব বলতে মা আমার বইপত্র গুছিয়ে আমাকে নিচে নিয়ে এল।
দুই দিদিও নিচে নেমে এল। তারপর থেকে ওই ঘরে আমি কক্ষনো ঢুকিনি। হতে পারে ওই ঘরের
কোনো পুরোনো ইতিহাস আছে। আমি জানি না। জিজ্ঞাসাও করিনি।”
এই
অব্দি বলে সমাপন উঠে পড়ল, “অনেক গল্প হলো, এবার পড়তে বসি যাই গিয়ে। কটা বাজে ?”
“সাড়ে
ছয়টা।” রঙ্গন বলল।
আধ ঘন্টা পর পুনরায় ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। ঠিক সাড়ে সাতটার সময় আবার কারেন্ট গেল। দত্তদা এসে জানিয়ে গেল আজকে আর কারেন্ট আসবে না কারণ কালী মন্দিরের কাছে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছে।