Subscribe Us

header ads

ডায়েরির সন্ধানে


আজ ২০২০ সালের ১৭ই  মার্চ মঙ্গল বার মাঝ রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সে বৃষ্টি কখনো থামছে, কখনো ঝিরঝিরিয়ে পড়ছে আবার কখনো মুষলধারে ঝরে পড়ছেনা ঘুমিয়ে আমি বিছানায় চোখ বুজে মুষড়ে পড়েছিলাম আজকে আর বেরানো হলো না কত উত্তেজনা, কত পরিকল্পনা সব মাটি

 

দুদিন আগে, ১৫ মার্চ রবিবার দিনটা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার পনেরো বছরের জীবনে ওই দিনটি যে সব চেয়ে উত্তেজনা পূর্ণক সেটা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

রহস্যের সূচনা হয়েছিল পুরীর সমুদ্র সৈকত থেকে। আসল ঘটনায় যাওযার আগে, ঘটনার মূল কেন্দ্র চরিত্র অর্থাৎ যাকে নিয়ে এত কিছু তার সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা যাক।

আজকে যার কথা বলতে যাচ্ছি সে আমার কাছে সম্পূর্ণই অজানা। আমি তাকে কোনো দিনও দেখিনি। কিন্তু না দেখলেও, তার জীবনে কি ঘটেছিল না ঘটেছিল সেসব আমি কিছু জানতে পেরেছি এবং আশাকরি আরও জানতে পারবো। আমি লিখালিখি করতে একটু ভালোবাসি কিন্তু, অনেক চেষ্টা করেও কোনো একটা কাহিনীকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করতে পারি না। তাই তার লেখা ডায়েরিটা যদি পেয়ে যাই তবে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আমার কোনো ভাষা থাকবে না বলা হয়েছে ডায়েরিতে নাকি অনেকগুলি গল্প কাহিনী এবং লেখকের জীবনের কিছু ঘটনা খুব যত্ন করে লেখা রয়েছে যেগুলো উদ্ধারকারীকে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে এবং নিজস্ব নাম দিয়ে। জানি না অন্যের লেখা গল্প নিজের নাম দিয়ে প্রকাশ করাটা ঠিক হবে কিনা। কিন্তু যেহেতু এই রকমই আদেশ রয়েছে, তাই যদি ডায়েরিটা উদ্ধার করতে পারি তবে আমি নিজের নাম দিয়েই গল্প গুলো প্রকাশ করবো। অবশ্য তার আগে যার ডায়েরি তার সম্পর্কে আমার কিছু কথা বলা দরকার এবং এটা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। ডায়েরির সন্ধান কিভাবে পেলাম সেটা পরে বলছি। আগে বলি ডায়েরিটা কার।

ডায়েরির লেখক : অংকুর সেন

                 জন্ম : ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬

             ঠিকানা : সিমলা, হুগলি

এই সমস্ত তথ্য আমি পেয়েছি একটি চিরকুট থেকে। যে চিরকুটটা ভরা ছিল একটি হোমিপ্যাথি সাইজের স্বচ্ছ কাচের শিশির ভেতর।

এবার, এই শিশির ভেতর চিরকুট কিভাবে পেলাম, তার থেকে ডায়েরির খোঁজ কিভাবে পেলাম এবং শেষমেশ লেখকের জীবনের অনেকাংশই কিভাবে জানতে পারলাম তার কথাই বলবো।

সবদিকে সামান্য বর্ণনা দিয়ে ঘটনাক্রম শুরু করছি, তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সামনের ২৬শে ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষা দিয়ে টেনের গণ্ডি পেরিয়েছি। অবশ্য রেজাল্ট এখনও বেরোয়নি, ওটা অনেক দেরি আছে। রেজাল্ট বেরানোর পর কার মনের অবস্থা কেমন থাকবে কিংবা কে কোথায় গিয়ে ভর্তি হবে সে সব অজানা। তাই রেজাল্ট বেরানোর আগেই টিউশন থেকে ক্লাস টেনের সবাই মিলে পুরীতে ঘুরতে যাওয়া হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল এবং সেই দিনটা হল আজ থেকে ঠিক দুদিন আগে ১৫ই মার্চ।

পুরীতে সমুদ্র দেখবো তাই উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে ছিল। সমুদ্র যে এর আগে দেখিনি এমনটা নয়। এর আগে দীঘাতে দেখেছি, এটা দ্বিতীয়বার। কিন্তু উত্তেজনার আসল কারণ আলাদা। শুনেছি দীঘার সমুদ্র উপকূলের চেয়ে পুরীর সমুদ্র উপকূল নাকি একটু বেশি খাড়াই। ঢেউয়ের উৎপাতটা দীঘার চেয়ে একটু বেশি, মানে একটু বেশি জোরালো। পায়ের নিচের বালি নাকি তরতর করে টেনে নিয়ে চলে যায় সমুদ্রের উন্মত্ত ঢেউ। অনেক জায়গায় নাকি আবার চোরাবালিও রয়েছে।

 

তাই গত রবিবার পুরীর সমুদ্রে যখন নামছি স্যার আগে থেকেই সাবধান করে দিলেন চোরাবালির ব্যাপারে। আমার সঙ্গে রয়েছে আরও দুটি ছেলে পিকু ও নন্দু। বেড়াতে এসে আমরা প্রথম থেকেই সদাসর্বদা একসঙ্গেই থেকেছি। তাই স্নান করার সময়তেও পাশাপাশিই রয়েছি।

পুরীর সমুদ্রের ব্যাপারে যা শুনেছি সবটাই ঠিক। প্রতিটা ঢেউয়ের টান এতটাই প্রবল যে বেশি দূরে যাওয়া যায় না। কিন্তু আনন্দের মাত্রা এই সব তুচ্ছ কারণের জন্য কমে যায়নি।

এবার বলি আসল ঘটনা।

সমুদ্রের নোনা জলে নাচানাচি করছি এমন সময় মনে হলো পায়ে যেন কিছু একটা ঠেকলো। প্রথমে ভাবলাম সমুদ্রের কোনো নুড়ি কিংবা পাথর জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু তারপর মনে হলো মসৃণ ধরনের চেনা কিছু একটা। জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে তুলে নিলাম জিনিসটাকে। দেখলাম ওটা আর কিছুই না, একটা ছোটো কাচের শিশি। হোমিপ্যাথি শিশি যেরকমটি হয় ঠিক সেই রকম।  কাচের রং স্বচ্ছ জলের মতো। ভেতরে কি আছে না আছে পরিস্কার দেখা যায়। শিশির গায়ে লেগে থাকা বালি গুলোকে ভালো করে পরিষ্কার করে দেখলাম ভেতরে যেন কিছু একটা রয়েছে। ঠিক করে দেখে বুঝলাম ওটা একটা কাগজ। ভেতরের কাগজটাতে কি আছে না আছে জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল কাগজটা বার করে দেখি। কিন্তু এই জলের মধ্যে কাগজটা ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে ভেবে আর বের করলাম না। তাছাড়া শিশির ঢাকনাটাও ভীষণ শক্ত।

ধর্মশালাতে এসে ভেজা জামা কাপড় ছেড়ে, কোনো রকমে শুকনো জামা কাপড় গলিয়ে তিনজনে বসে পড়লাম কুড়িয়ে পাওয়া শিশির রহস্য ভেদ করতে।

শিশির ঢাকনা খুলতে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল। কবে কোন কালে কে শিশির ভেতর কাগজ ভরে ফেলেছিল তার কোনো হিসেব নেই। কিন্তু শেষ মেশ হেনতেন উপায়ে খুলেই ফেললাম। ভেতর থেকে বেরালো একটা সিল করা ছোটো প্লাস্টিকের থলির মতো কি একটা। প্লাস্টিককে আগুনে তাঁতিয়ে খোলা মুখ সিল করলে যেরকম হয় ঠিক সেইরকম। ওটা ছিঁড়তে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো গোল করে পাকানো কাগজটা। বুঝলাম কাগজটা যাতে ভিজে না যায় সে দিকে ভীষণ খেয়াল রাখা হয়েছে।

কাগজটা প্রথমে ছোটো দেখালে কি হবে, পুরোপুরি ভাঁজ খুলতে হয়ে গেল একটা A4 কাগজের অর্ধেক। পেনসিল দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা হয়েছে চিরকুটটা। যে লিখেছে তার হাতের লিখার তারিফ করতে হয়। পুরো ছাপানো লিখার মতো হাতের লেখা।

কাগজের একদিকে কিছু লেখা হয়েছে, উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেখি একটা ম্যাপ আঁকা। ম্যাপ দেখে তো উত্তেজনায় তিনজনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল।

পিকু আর নন্দু এতক্ষন অব্দি কিছুই বলেনি, শুধু দেখছিল। হঠাৎ কাগজের পেছনে ম্যাপ দেখে উত্তেজনা দমন করতে না পেরে দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, “গুপ্তধন নাকি রে!

“বুঝতে তো পারছি না এটা কোথাকার ম্যাপ। ছোটো ছোটো করে কিছু নাম লেখা রয়েছে।

নাম গুলো পড়া শেষ করে বুঝলাম, আমি একটা জায়গাও চিনি না। মাথা তুলে ওদের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম, দুজনে নিজেদের মধ্যে তাকানো শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃতি করে না সূচক ইঙ্গিত করছে।

সবটা জানার আগ্রহ আমাকে ব্যাকুল করছিল। সামনে কি লেখা আছে পড়তে হবে। তাই সময় নষ্ট না করে বললাম, ”যাক গে ছাড়, বাড়ি গিয়ে দাদাকে বললে আশাকরি বলে দেবে এটা কোথাকার ম্যাপ।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই বেস্ট।” নন্দু বলল।

পড়বার জন্য আমি কাগজটা ঘোরাচ্ছি সেই মুহূর্তে পিকু হটাৎ বলে উঠল, “আমায় দিবি নাকি তুই পড়বি?

বুঝতেই পারছি আমার মতো ওরাও ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, “না আমিই পড়ছি।”

কাগজের পুরো অংশতেই লেখা হয়েছে, এতটুকু জায়গাও ফাঁকা ছাড়া হয়নি। প্রথমটায় লেখক তার নিজের পরিচয় দিয়েছে। তার নিচের পঙক্তিতে বোধ হয় রয়েছে আসল রহস্য। আমি পরিচয় দিয়েই শুরু করলাম।

“অংকুর সেন, জন্ম - ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, ঠিকানা...।”

“হোয়ে হোয়ে গুপ্তধন-গুপ্তধন, ধনী হয়ে যাবো এবার আমরা। এবার শুধু টাকায়...।

পিকুর এমনতর চিৎকার শুনে আমি চমকে উঠলাম। ও আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নন্দু ওর মুখ চেপে ধরায় চিৎকারটা 'টাকায়' অব্দি গিয়ে থেমে গেল।

“আরে চুপ চুপ। চিৎকার করে আর সবাইকে জড়ো করবি নাকি।” চাপা স্বরে কথাটা বলে পিকুর মুখ থেকে হাত সরালো নন্দু।

“চিৎকার করছিস কেন তুই ? আস্তে আস্তে কথা বলা যায় না। আর এটাতে যে গুপ্তধনেরই কথা লেখা রয়েছে সেটাতো এখনো নিশ্চিত হয়নি। সবেতেই বাড়াবাড়ি, সবাই জেনে গেলে ভালো হবে ?”

ধমক দিয়ে আমি এক চোট মুচকি মুচকি হেসে নিলাম। আমায় হাসতে দেখে একটু আগের বকুনি ভুলে পিকু বলল, “আচ্ছা পড় তুই।”

“হুগলি জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম সিমলাতে আমার জন্ম। খুব ছোটো বয়স থেকেই আমি গল্পের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এর পেছনে অবশ্য আমার মায়ের হাত ছিল। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে মায়ের কোলে মাথা রেখে রূপকথার রাজকুমার-রাজকুমারীদের গল্প শুনতাম। ব্যাপারটা এরকম হয়ে দাঁড়ায়, একদিন যদি ভুল করে মায়ের কাছে গল্প শুনতে না পেতাম তবে সেদিন রাতে আমার ঘুম ঠিকঠাক হতো না।

এরপর থেকে যখনই কোথাও বইয়ের দোকান দেখতাম সঙ্গে সঙ্গে বই কেনার আবদার জুড়ে দিতাম। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুভব করলাম আমার মধ্যে লেখালেখির একটা আগ্রহ বাড়ছে ধীরে ধীরে। মা বোধহয় সেসব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ক্লাস ফাইভে উঠার পর যখন আমার জন্মদিন এল, মা আমাকে ইয়া বড় বড় দুটো ডায়েরি গিফট করলেন জন্মদিনের উপহার হিসেবে। ডায়েরি পেয়ে আমি তো ভীষণ খুশি। মাকে বললাম, তুমি দেখে নিও একদিন আমি খুব বড়ো লেখক হবো। মা হেসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আচ্ছা আমার সোনা ছেলে।

ক্লাস সিক্সের জন্মদিন আসার আগেই মা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। সেদিন রাতে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কারণ প্রতি রাতে গল্প বলে যে আমায় ঘুম পাড়াতো সেই জন্মদাত্রী মা ছিল না আমার কাছে। মায়ের ছবি বুকে রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সে রাতে, আমি নিজেও জানি না। তারপর থেকে মায়ের সেই ছবি, রাতে আমার ঘুমানোর জন্য মোক্ষম ঔষুধির কাজ করতো।

বাবা কাজের সূত্রে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকতেন। আমার পড়াশোনার যাতে কোনো প্রকারের অসুবিধা না হয় সেই কারণে মামা আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে মেদিনীপুর কলেজে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। এত কিছুর মধ্যে আমার লেখালেখি কিন্তু থেমে থাকেনি। অনেক গুলো কাহিনী লিখেছি মায়ের দেওয়া সেই ডায়েরিতে। অবশ্য একটাও কাহিনী এখনো পর্যন্ত প্রকাশ করে উঠতে পারিনি।

মেদিনীপুরের মেসে এসে কয়েকজনের সঙ্গে বেশ ভালো রকমের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেমন আমার রুমমেট রঙ্গন এছাড়া সৌভিক ও অঞ্জন। এদের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হলো সেসব আমার ডায়েরির ‘দ্বিতীয় পুরস্কার’ গল্পতে লেখা রয়েছে। ওহ্ হো এতক্ষন তো আসল কথাই বলা হয়নি। ডায়েরিটা একটা সুরক্ষিত জায়গায় প্লাস্টিকের মোড়কে জড়িয়ে মাটির নিচে সংরক্ষিত করে রাখা আছে দেওয়াল জড়িয়ে বুড়োর পেটে মাটির নিচে ডায়েরি পাবে সেই ডায়েরিতে অনেক গুলো গল্প ও ঘটনা লেখা রয়েছে। যে এই কাচের শিশির ভেতরে রাখা কাগজটা পাবে, সেই আমার ডায়েরির স্বত্বা পাবে এবং সমস্ত কাহিনী নিজের নাম দিয়ে প্রকাশ করতে পারবে। এই অনুমতি আমি স্বয়ং তাকে দিলাম। অবশ্য সে যদি শিশির ভেতর রাখা আমার এই লেখাটাও প্রকাশ করে, তবে তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।”

”ধুর ফালতু যতসব গাঁজাখুরি কথাবার্তা। নিজের লেখা কেউ কখনো অন্যকে প্রকাশ করতে দেয়।  তুইও এটা বিশ্বাস করে এতক্ষন ধরে মন দিয়ে পড়ছিস লেখাটা। আমি হলে এতক্ষনে কাগজটাকে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসতাম। যতসব আজগুবি কথাবার্তা, ধুর” পিকু রেগে এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে উঠে গেল।

আমি আর নন্দু পাঁচ সেকেন্ড পিকুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পাঁচ সেকেন্ড পর ও অদৃশ্য হতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, ”একটুও ধৈর্য নেই ছেলেটার। পুরোটা শুনে যেতে পারতো।” 

নন্দু বলল, ”ছাড় তো ওর কথা ব্যাপারটাতে অ্যাডভেঞ্চার আছে বুঝলি, পড় বাকিটা। দেখি কি বলেছে শেষ অব্দি।”

“হুম্ পড়ছি।” যেখানে থেমেছিলাম তার পর থেকে আবার পড়া শুরু করলাম।

“অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা তাই না। নিজের লেখা স্বয়ং প্রকাশ না করে অন্যকে কেন বলছি। আসলে আমি যে প্রকাশ করতে চাইনি এমনটা নয়। অনেকবার চেষ্টা করেছি, সংখ্যাটাও এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু আমাকে সবাই পাগল বলে ভাগিয়ে দিয়েছে। সবাই আমাকে দেখলে পাগল পাগল বলে হাসাহাসি করে। আমি পাগল, কেন পাগল, সবাই কেন পাগল বলে আমাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পাগল। না, না আমি পাগল নই, আমি পাগল নই। আমার জন্যই জয়শ্রী এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিল আমি পারিনি তাকে বাঁচাতে, আমি পারিনি। আমাকেও যেতে হবে তার কাছে, হ্যাঁ হ্যাঁ যেতে হবে। আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি জয়শ্রী ভীষণ ভালোবাসি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি থামলাম। নন্দু চকচকে দাঁত বের করে রসিক বাবুটি হয়ে বলল, ”এ তো দেখছি প্রেমের জোয়ার লেগেছে না জানি ডায়েরিতে কি কি আছে যাক গে এখানেই শেষ, নাকি আর কিছু আছে ?”

“শেষে বলেছে, কাগজের ম্যাপটা ঠিকঠাক বুঝতে না পারলে ফেসবুকে গিয়ে দেখতে। ফেসবুক আইডি, অংকুর সেন অফিসিয়াল, তাছাড়া আর কিছু নেই।”

বেড়াতে এসে নন্দু ওর টাচ স্ক্রীন মোবাইলটা নিয়ে এসেছিল। বাবা নতুন মোবাইল কিনেছে তাই ভাঙা ফোনটা ছেলের ভাগ্যে জুটেছে নন্দু কিন্তু নতুন মোবাইলের জন্য বায়না করছিল ওর বাবার কাছে, কিনে দেয়নি, বলেছে মাধ্যমিকে ভালো মত রেজাল্ট করলে তবেই কিনে দেবে। তবে এই ফোনটা যে খুব খারাপ তা নয়, শুধু স্ক্রীনটা একটু ভাঙা আর সব ঠিকঠাক। ভালো ছবি তোলা হয়, আবার ইন্টারনেটও চলে।

আমি যতক্ষণে অংকুর সেনের ফেসবুক আইডিটা বললাম নন্দু ততক্ষনে ওর ইন্টারনেট চালু করে দিয়েছে। তিন মাস আগে ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। ফেসবুক খুলে সার্চ অপশানে গিয়ে অংকুর সেন অফিসিয়াল লিখে সার্চ করতেই অংকুর সেনের অ্যাকাউন্ট বেরিয়ে গেল। অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার বছর আগে। পাবলিক পোস্ট বলতে কয়েকটা গল্প কাহিনী, স্কুল ও কলেজের ছবি আর কিছু প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি, যেমনটা সবাই পোস্ট করেবাকি বন্ধু বান্ধব, পরিবার কিংবা একা অংকুর সেনের কোনো ছবি দেখতে পেলাম না। বোধ হয় ওগুলো অনলি ফর ফ্রেন্ড কিংবা প্রাইভেট করা আছে।

যাই হোক আমাদের যেটা দরকার সেটা পেয়ে গেলাম, বছর খানেক আগের করা একটা পোস্টে। গুগল ম্যাপের কয়েকটা স্ক্রীন শট আর সঙ্গে লিংক দেওয়া রয়েছে। লিংকে ক্লিক করতেই গুগল ম্যাপ জুম হতে হতে একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হলো। জায়গাটার নাম টাকি বাংলাদেশের বর্ডারের কাছে ইচ্ছেমতী নদীর তীরে পশ্চিমবঙ্গের একটা ছোট্ট শহর

আচ্ছা নন্দু, তুই আমাদের বাড়ি থেকে এই জায়গাটার দূরত্ব কত দেখ তো

নন্দু দূরত্ব দেখে বলল, “এতো অনেকটাই রে, ২০০ কিলোমিটার

যাবো একদিন

তোর কি মনে হয়, বাড়িতে যেতে দেবে ?”

যেতে না দিলে, লুকিয়ে যাবো আমরা

কি বলছিস কি, মাথা খারাপ নাকি বাড়িতে জানতে পারলে পিঠের ছাল চামড়া খুলে নেবে

উফ্! বাড়িতে জেনে যাবে, বাড়িতে জেনে যাবেজীবনে একটু অ্যাডভেঞ্চারের কথা তো ভাবতে পারিস এত ভয় করলে হবে তুই জানিস আমাদের চেয়েও অল্প বয়সেঅনেক জ্ঞানের কথা এবং আসল বন্ধুই সদা সর্বদা বিপদে আপদে পাশে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আধ ঘন্টার পর নন্দুকে রাজি করালাম ঠিক করা হলো মঙ্গল বার ১৭ই মার্চ আমাদের যাত্রা শুরু হবে মিশন ডায়েরির সন্ধানে

 

দাঁত মেজে খাওয়া দাওয়া সেরে যখন পড়তে বসেছি, তখন চারদিক আবার অন্ধকারে ভরে গেলপড়াশোনায় মন নেই আজ কাজের কাজটি কিছুই হলো না যেখানে, সেখানে পড়াশোনায় মন বসানো মুশকিল বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে কালো মেঘ আর বৃষ্টি পড়া দেখছি দেখছি আর ভাবছি, আজকে তো যাওয়া হলো না, আবার কবে যাওয়া হয় বিকেলে যদি বৃষ্টি থামে তবে নন্দুর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে

বিকেলে বৃষ্টি থামলো দুজনে কলেজ মাঠের ব্রেঞ্চে গিয়ে বসলাম মাঠ প্রায় জনশূন্য রাস্তা-ঘাটেও এখন লোকে কম বের হয়Covid-19 নামের কী একটা মারণ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে চারপাশে তাই আগের মতো আর ভিড় চোখে পড়ে না ভয়ানক এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও নাকি সংক্রমিত হয় তাই সবার মুখে মাস্ক লাগানো বাধ্যতামূলক বলে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে আমরা দুজনও মুখে মাস্ক পরে কথা বলছি

কবে যাবি তবে ?”

চারদিকে করোনা কিরকম বাড়ছে তো দেখতেই পাচ্ছিস এই সময় যাওয়াটা নিরাপদ হবে কি ?

অনেক দেশে লকডাউন পড়ে গেছে আমাদের এখানেও যদি লকডাউন হয় তবে সব ভেস্তে যাবে এটা কিন্তু একটা ভালো সময় এমনিতেই খুব কম লোকজন বাড়ি থেকে বের হবে এই সময়, আগের মতো ভিড় থাকবে না কিন্তু লকডাউন শুরু হলে বাড়ি থেকে বেরোতেই পারবি না একদিন চল সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসবো কিন্তু বাড়িতে কি বাহানা দেবো সেটাই ভাবছি।”

যাবিই যখন ভেবে নিয়েছিস, চল তবে একদিন বাড়িতে কি বলবি সেটা ভেবে নে এখনি

 

২০মার্চ শুক্র বার, মেদিনীপুর স্টেশনে রাত দেড়টার ট্রেনে উঠে পড়লাম বাড়িতে বলে এসেছি, ক্লাস ইলেভেনের প্রজেক্টের জন্য পুরোনো ঐতিহাসিক কোনো রাজবাড়ী সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে হবে যাতে সঠিক তথ্য এবং ছবি অ্যাটাচমেন্ট বাঞ্ছনীয় তাই কয়েকজন মিলে রাজবাড়ী যাচ্ছি কিন্তু কোথাকার রাজবাড়ী সেটা আর বলিনি ভাগ্যিস দাদা ছিল না, তাই আসতে পেরেছি

দুজনে জানালা ধারে সামনা সামনি বসেছি দুজনের কাছেই দুটো কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ রয়েছে তাতে একটা জলের বোতল, একটা ছোটো শাবল, একটা পেন, একটা ডায়েরি, দুটো মাস্ক যার একটা পরেছি আর একটা ব্যাগে রাখা আছে আর বাকি কিছু পরিপোশাক যেমন একটা ফুল প্যান্ট, একটা জামা, একটা হাফপ্যান্ট আর একটা গামছা যদি ইচ্ছেমতী নদীতে স্নান করা হয় সেই উদ্দেশ্য

ট্রেন স্টেশন ছেড়ে কিছুদূর যেতে নন্দু আশঙ্খা ভরা সুরে বলল, “কাকু যদি স্কুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করে তখন কী করবি ?”

আজ তো স্কুল ছুটি

কিন্তু অফিসের কাজ তো হবে তাই না

হ্যাঁ ঠিক কথা, কিন্তু বাবা জিজ্ঞাসা করবে বলে মনে হয় না

যদি অঞ্জনদা জিজ্ঞাসা করতে বলে ?”

আমি মৃদু হেসে বললাম, “দাদা বাড়িতে নেই, জেঠুর কাছে গেছে

তবে ঠিক আছে

আর তোর

না, প্রশ্নই ওঠে না বাড়িতে জানে আমি কেমন

ওর কথায় আমার নিঃশব্দ হাসিটা কান পর্যন্ত পৌঁছালো খারাপ কিছু বলেনি ওর মতো বিটকেল ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি

বাইরে ঘন অন্ধকারমেদিনীপুর থেকে খড়্গপুরে ট্রেন দাঁড়ানোর পর পাঁশকুড়া তে আধঘন্টা লেট করে ট্রেন ঢুকল একজন RPF এসে দুজনকে এক মিটার দূরত্বে বসিয়ে দিয়ে গেল মনে মনে ভাবছিলাম ফাইন নেবে নাকি, কিন্তু না কোনো ফাইন নিল না পরবর্তী স্টেশন একেবারে হাওড়া জংশন

সাড়ে চারশো টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি নন্দু নিয়েছে পাঁচশো যাতায়াতে দুজনের মিলে খরচ আশাকরি চারশোর মধ্যে হয়ে যাবে কিছু শুকনো খাওয়ার কিনতে হবে হাওড়াতে ভোর সাড়ে চারটায় ট্রেন থেকে নামবো ৫টা ২০তে শিয়ালদা-হাসনাবাদ লোকাল ধরার আগে যা কেনবার কিনে নিতে হবে

একটু জেগে একটু ঘুমিয়ে ৪:৪০ এ হাওড়াতে পৌছালাম এর আগে আমি দুবার কলকাতায় এসেছি, নন্দু এসেছে পাঁচবারওর অভিজ্ঞতা একটু বেশি, তাই ওকে সামনে এগিয়ে যেতে বললাম। বন্ধুর পেছন পেছন পৌঁছলাম বাসস্ট্যান্ডে বাসস্ট্যান্ডের ভিড় উপেক্ষা করে অর্ধেক ঘেমে বাস থেকে নেমে যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছলাম তখন ট্রেন ছাড়তে আর ১৭ মিনিট বাকি নন্দু গেল টিকিট কাটতে, আমি গেলাম খাবার কিনতে

খাবার কিনে নন্দুর জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু নন্দু কোথায় ট্রেন ছাড়তে দু মিনিট বাকি এদিকে নন্দুর দেখা নেই প্রচুর টেনশান হচ্ছে এমন সময় নন্দু হঠাৎ কোত্থেকে ভুতের মতো আবির্ভূত হয়ে আমার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চল চল ট্রেন ছেড়ে দেবে

ওর সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে বললাম, “এত দেরি হল ?”

এমনিতেই ভিড়, তার উপর করোনার জন্য নানান নিয়ম মাস্কটা ভালো করে পর

মাস্কটা ভালো করে পরে ট্রেনে উঠা মাত্র ট্রেন ছাড়ল

ট্রেন জার্নি কার কেমন লাগে জানি না কিন্তু আমার তো ভীষণ ভালো লাগে প্লাটফর্মে লোকজনের চলাচল, ট্রেন আসা যাওযার সমাচার, দীর্ঘ রেল লাইনে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ট্রেনের যাত্রা যাত্রা পথে কত অচেনা মানুষের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় কত না দেখা পথ ঘাট, নদী, বন, পাহাড়, সমুদ্র প্রতি ঋতুতে নিজেদের রূপ পরিবর্তন করে দিবারাত্রি পথযাত্রীদের আকর্ষণ করে চলেছেকিন্তু এখন নিজেকে সেই আকর্ষণের মায়াজাল থেকে আমি অতি সহজেই মুক্ত করতে পারবো কারণ ভীষণ ঘুমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে ব্যাগের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়তে হবেকিন্তু নন্দু কোথায় গেল? জানালাধার থেকে সরে সিটের অন্য কিনারায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখি নন্দু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে একবার ও পিছন ফিরে আমার দিকে তাকালো, আমি ততক্ষণে ব্যাগের উপর মাথা রেখে শরীরটাকে টান টান করছি চোখ বন্ধ করতেই বহির জগতের সকল শব্দ ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো

 

এই ওঠ রেওঠ ওঠ উঠে পড়, এসে গেছি আমরা।

উঠে বসে হাই তুলতে তুলতে বললাম, এর মধ্যে চলে এলাম?”

হ্যাঁ চলে এসছি। তুই তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলি তাই।”

তুই ঘুমাসনি?”

হ্যাঁ ওই একটু খানি নে চল চল, দেরি করিস না

আরে মাস্কটা পর

ও হ্যাঁ হ্যাঁ

একদম সঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে থেমেছে ট্রেন থেকে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। উত্তর থেকে দক্ষিনে চলে গেছে সিঙ্গেল ট্রাকের ট্রেন লাইনটা দক্ষিণে হাসনাবাদ শেষ স্টেশন স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। নন্দু ম্যাপ দেখে বলল, এরপর পুব দিকে দু কিলোমিটার যেতে হবে

একটা খালি টোটো দাঁড়িয়ে ছিল গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কাকু রাজবাড়ী যাবেন ?”

হ্যাঁ বসো

রাস্তায় যানবাহন, মানুষ জনের চলাচল খুবই কম অধিকাংশ দোকানে ঝাঁপ বন্ধ নিশ্চয়ই করোনার কারণে

পাঁচ মিনিটেই টোটো আমাদের দুজনকে রাজবাড়ীর সামনে পৌঁছে দিল কুড়ি টাকা ভাড়া মিটিয়ে দেরি না করে ঝটপট রাজবাড়ির দিকে রওনা দিলাম

রাজবাড়ী কিন্তু মোটেও শুনশান নয়লোকজন রয়েছে কিন্তু কম চোখের সামনে কত শত বছরের পুরনো স্থাপত্য তা অজ্ঞাতএলাকার লোকে জানতে পারে, সময় করে জিজ্ঞেস করতে হবে

প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো

আমি অবাক হয়ে নন্দুর দিকে তাকালাম নন্দু দাঁত বের করে মোবাইলের স্ক্রিন টা আমার চোখের সামনে ধরে বলল, “গুগল থেকে

ওকে, আচ্ছা শোন বটগাছটা কোনদিকে আছে খুঁজতে হবেচারদিকেই তো গাছপালা ওই তো মনে হয় বটগাছটাআমি ব্যাস্ত হয়ে বললাম

নন্দু ক্যামেরা উঁচিয়ে বলল, “একটা সেলফি তুলি আয়

ওসব সেলফি-টেলফি পরে হবে চল আগে খুঁজি ওটা

না আগে সেলফি, পরে খোঁজা খুঁজি

রাজবাড়ীকে নিয়ে নন্দু বেশ কয়েকটা সেলফি তুলল একবার নিজেরএকবার দুজনের আবার একবার বলে ফ্রন্ট ক্যামেরায় তার একার ছবি তুলে দিতে অদ্ভূত সব পোজ দেওয়া বিশটা ছবি তুলে বললাম, “হয়েছে এবার ?”

হ্যাঁ একদম দেখি এবার ছবি গুলো কেমন এসছে?”

বাড়ি গিয়ে দেখবি তুই চল এখন

ভাঙ্গা দেয়ালের সঙ্গে, খানিকটা নিজের উপর ভর করে খানিকটা দেয়াল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাত কাটা আদ্দি কালের বুড়ো বট দেয়ালের অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে ভাঙ্গা ইটের টুকরো গুলো বুড়ো বটের পায়ে স্তুপের আকার নিয়েছেদেওয়ালের অনেকটা জায়গা জুড়ে বটগাছের গুড়ি ডায়েরিটা কোথায় লুকোনো রয়েছে ঠিক সেই জায়গাটা খুঁজে নেওয়া বেশ মুশকিল

মাথা কামড়ে বললাম, “কোথায় খুঁজি বলতো নন্দু?”

চিরকুটে কি লেখা ছিল?

দেওয়াল জড়িয়ে বুড়োর পেটে মাটির নিচে ডায়েরি পাবে।”

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা সেই জায়গা দেওয়াল আছে, বুড়ো বলতে বট গাছকে বোঝাচ্ছে সব তো মিলে যাচ্ছে রে।

মাথার চুল ছিঁড়ে বললাম, সে তো একটা বাচ্চাও বলতে পারবেকিন্তু পার্টিকুলার কোন জায়গাটায় রয়েছে সেটা তো বের করতে হবে নাকি তুই চারদিক খুঁড়ে বেড়াবি। চারপাশে কত লোকজন ঘোরাঘুরি করছে দেখছিস তো একবার দেখতে পেলে ইচ্ছামতির মাঝে ফেলে দিয়ে আসবেচল ওই ইট গুলো একটু সরিয়ে দেখি

দুজনে মিলে বটগাছের গোড়া থেকে ইটের টুকরোগুলো সরাতে লাগলাম মাঝেমধ্যে হঠাৎ কেউ চলে এলে ডায়েরি বের করে আবোল-তাবোল লেখা শুরু করে দিই আবার চলে গেলে কাজ শুরুআধঘন্টায় অনেকটা জায়গা ফাঁকা করলাম বট গাছের ঝুরি নেমে মোটা আকার ধারণ করেছেঅনেকগুলো ঝুরির মাঝে একজন মানুষ যাওয়ার রাস্তা হতেই খুব সাবধানে তার ভেতর প্রবেশ করলাম ভেতরটা ভেজা স্যাঁতসেতে, আলো কম নন্দু মোবাইলের টর্চ জ্বালাতে দেখলাম ভেতরে অনেকটা জায়গা ফাঁকা দেওয়ালের সঙ্গে বটগাছের কোনো সংযোগ নেই বাকি চারদিক ঝুরির আচ্ছাদনে ঘেরাএটাই তবে বুড়োর পেট এখানে মাটি খুঁড়লে তো কেউ টেরই পাবে না ভেজা মাটি, শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলামনন্দু বাইরে পাহারায় দাঁড়াল

ফাঁকা দেওয়াল যেখানে মাটির সঙ্গে মিশেছে সেখানেই খুঁড়তে হবে। ফাঁকা দেওয়ালের মাঝে টিউব লাইটের মতো একটা সরু ঝুরি মাটি ফুঁড়ে ঢুকে গেছেডানদিকের মোটা ঝুরি থেকে সরু ঝুরির দূরত্ব দুহাত সরুঝুরি থেকে বামদিকের মোটা ঝুরি দূরত্ব একহাতের একটু বেশিমোট কথা দেওয়াল ধার বরাবর আমাকে তিন হাতের বেশি মাটি খুঁড়তে হবে

বুড়োর পেটে হাওয়া চলাচল কম খানিকক্ষণ মাটি খুঁড়েই ঘেমে নেয়ে একসা হলামআরো কিছুক্ষণ ডান দিকের দুহাত বিস্তৃত জায়গায় মাটি খুঁড়ে কিছুই পেলাম না তবে কি সব কিছু ভাওতা বাজি! বোকার মতো অন্যের ঠাট্টা তামাশার ফাঁদে পা দিলামনিরাশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম বাইরের হাওয়া গায়ে লাগাতে একটু স্বস্তি অনুভব করলাম

নন্দু, হাতে আমার ডায়েরিটা নিয়ে বসেছিল। আমায় দেখে বলল, “এ বাবা! তুই তো একদম ঘেমে গেছিস রে আমি একটু যাবো খুঁড়তে?”

না না তুই এখানেই থাক ভেতরে প্রচুর ভাবসা গরম আগ বাড়িয়ে স্নান করার কোনো দরকার নেই

কিছুক্ষণ বাইরে থেকে আবার ভেতরে গেলাম বাকি কাজটা সারার জন্য  এতদূর যাত্রা করে এসেছি যখন একবার দেখেই যাই মিনিট পাঁচেক মাটি খোঁড়ার পর হঠাৎ বাইরে অচেনা একজনের গম্ভীর গলা শুনে থেমে গেলাম

এই কি ব্যাপার? কি করা হচ্ছে এখানে?

সর্বনাশ হয়েছে! লোকটা কি টের পেয়ে গেল নাকি? আমার বুক ধুকপুক শুরু হলো নন্দুকে দেখলাম বেশ চালাকি করে উত্তরটা দিল

ইয়ে মানে কাকু প্রজেক্ট লিখতে এসছিলাম একটু আর কি

এই জঙ্গলে ভর দুপুরে প্রজেক্ট, ইয়ার্কি পেয়েছ।”

এবার দেখলাম নন্দু কান্নার অভিনয় করে বলা শুরু করেছে, “হ্যাঁ কাকু আর বলবেন না দায়ে পড়েই আসতে হয়েছে আমাদের যে বাংলার স্যার রয়েছেন সে ভীষণ রাগী মেরে ছাল ফাটিয়ে দেয় পুরনো বটগাছ সম্পর্কে লিখতে বলেছেননা লিখলে ছাল ফাটাবেন আগেও ফাটিয়েছেন এই দেখুন না দাগ

নন্দুর পিঠে আবার দাগ কবে হল যে দাগ দেখাবে আমি আড়াল থেকে দেখলাম ও বলছে, “টি শার্ট টা ভীষণ টাইট নাহলে খুলে দেখিয়ে দিতাম এবার আপনি বলুন কি করবো আমি না লিখে নিয়ে গেলে পিঠে আরো পাঁচটা দাগ বেড়ে যাবে।”

ঠিক আছে ঠিক আছে দেখাতে হবে না এদিকে মাঝেমধ্যেই সাপ খোপ বের হয়, তাই সাবধান করে দিতে এলাম বেশিক্ষণ থেকো না এখানে।”

বাইরে কথাবার্তার ফাঁকে আমি অতি সাবধানে মাটি খুঁড়ে হাত দিয়ে আলগা মাটি সরাচ্ছিলাম হঠাৎ হাতে মোটা পলিথিনের মতো কিছু একটা ঠেকলো। উত্তেজনায় আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল বোধহয় পেয়েছি চার পাশের মাটি খানিক আলগা করে টান মারতে হবে, না হলে বেরোবে না লোকটা যতক্ষণ ছিল চুপচাপ বসে ছিলাম কথাবার্তা শেষ করে চলে যেতেই জোর টান মারলাম বেরিয়ে এলো মোটা চ্যাপ্টা ডায়েরিটা আনন্দে নাচতে লাগলাম এবার এখান থেকে বেরোতে হবে কিন্তু বেরোনোর পথে ওটা কি? মোটা কালো রঙের একটা লম্বা বস্তু বটগাছের ঝুরির সঙ্গে পেঁচিয়ে নিচের দিকে নামছে। ওটা যে কী সেটা আমার বুঝতে আর বাকি রইল না। গায়ে আবার কাঁটা দিল এটা আনন্দের নয় ভয়ের কাঁপতে কাঁপতে বললাম, “নন্দু, সা সা সা সা সাপ।”

নন্দু চমকে উঠে বলল, কোথায়?”

বট গাছের ঝুরি বেয়ে নামছে

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নন্দু বলল, “গোখরো

গ গ গ গ গোখরো কী কী করবো এবার ভাই?”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক একদম নড়বি নাসাপ চলে গেলে বেরাবি

আমি স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম এক মিনিট পর বললাম, “গেছে?”

না

আবার এক মিনিট পর বললাম, “গেল?”

না, না যায়নি এখনো

উফ্ কখন যাবে!” কতক্ষন অপেক্ষা করতে থাকলাম জানি না মনে হলো সে অপেক্ষার যেন কোন শেষ নেই একটা ছোট্ট সময়কে জীবনের অর্ধেক আয়ু বলে মনে হতে লাগলোএবার গেছে?”

হ্যাঁ এবার বেরিয়ে আসতে পারিসচলে গেছে

বাইরে বেরিয়ে এসে বললাম, “কোন দিকে গেল?”

ও তোর বউ নাকি? ওই দিকে গেছে যাবি তো যা পেছন পেছন

হুস, চল এখান থেকে

 

দুপুর একটার সময় নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম মন জুড়ানো ফুরফুরে হাওয়া বাংলাদেশের দিক থেকে নদী পেরিয়ে ভারতে আসছে ওই দূরে বাংলাদেশ, মাঝে ইচ্ছে মতি নদী একসময় ওটা আমাদের দেশ ছিল চোরের দল এসে বিভাজন করে গেছে

নদীতে স্নান করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু নদী পাড়ের কাদা জল দেখে ইচ্ছে দমন করলাম মাঝ নদী কিংবা রাজবাড়ির ঘাট হলে ঠিক ছিল, এখানে স্নান করতে নামা মানে কাদামাখা রাজবাড়ির ঘাটে লোকের ভিড় করোনার সময় এসব ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়

নদীর এখানে ওখানে কয়েকটা নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে রাজবাড়ীর ঘাটে ঢোকার সময় উপরে লেখা দেখেছিলাম, যন্ত্র চালিত বোটে নৌকা ভ্রমণ হয়। দুজনের ইচ্ছেতে শেষমেশ একটা নৌকাতে উঠে বসলাম নৌকা চালকের বয়স তিরিশের কাছাকাছি কাকু বলে সম্বোধন করতে হেসে বলল, “একদম কাকু দাদা বললেই বেশি খুশি হবো

নৌকা ধীরে ধীরে মাঝ নদীর দিকে এগাচ্ছে নন্দু এদিক ওদিক ক্যামেরা ঘুরিয়ে ছবি তুলছে আমি নৌকা চালকের উদ্দেশ্য বললাম, “আচ্ছা দাদা এখানে আশেপাশে কি কি বিখ্যাত জায়গা রয়েছে?”

টাকি রাজবাড়ীতে প্রতিবছর শরৎকালে বিরাট ধুমধাম করে দুর্গোপুজো হয়  ৩০০ বছরের পুরনো দুর্গাপুজো বুঝলে তো  ৩০০ বছরের পুরনো শিব মন্দিরও রয়েছে এখানেএছাড়া মাছরাঙ্গা দ্বীপ, গোলপাতা জঙ্গল আর রাজবাড়ী তো রয়েইছে মাছরাঙ্গা দ্বীপে নৌকো করেই যাওয়া যায়যাবে নাকি একবার?

না না দাদা আজকে সময় হবে না, পরে কোন একদিন যাবো।নন্দু বলল

প্রায় মাঝ নদীতে এসে গেছি এবার স্নানটা করে নিই নন্দু স্নান করবি তো?”

আমার কথা শুনে নৌকা চালক চমকে উঠে বলল, “এ এ এ এই এখানে কোন স্নান-টান নয় স্নান করার ইচ্ছে হলে ঘাটে গিয়ে করবেএখানে স্নান করতে কেউ দেখে নিলে আমার নৌকো চালানো মুশকিল হবে।”

আমি জামাকাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে বললাম, “এই ঝুপ করে নামব আর টুক করে ডুব দিয়ে উঠে পড়বো বেশিক্ষণের ব্যাপার না, দু মিনিট।”

নৌকো চালক বারণ করেও কোন ফল পেল না আমি জলে নেমে ডুব দিলাম ঠান্ডা জলের স্পর্শে মন প্রাণ একেবারে ভরে গেল। বিশাল নদী, দূরে নদী পাড়ের গাছগুলো ছোট ছোট দেখাচ্ছে কত জল, গভীর কত হবে, অনেকটা নিশ্চই দু মিনিটের আগেই নৌকোতে উঠে পড়লাম

ছবি তুললি?”

হ্যাঁ তুলে নিয়েছি

যা এবার তুই তাড়াতাড়ি স্নানটা করে নে?”

না আজকে আর স্নান করবো না

তোর ব্যাপার। আচ্ছা দাদা এখানে আশেপাশে হোটেল কোথায় রয়েছে?”

করোনার কারণে এখন প্রায় হোটেলই বন্ধ একটা হোটেলের নাম বলছি, আশা করি খোলা থাকবে, ওখানে যেতে পারো।

 

নৌকো চালকের বলে দেওয়া হোটেলটা খোলাই ছিল হোটেলে মাছ-ভাত সাটিয়ে টোটোতে করে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম  আরো কিছু জায়গা দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ২টো বেজে ৫৬ মিনিটের ট্রেনটা ধরার জন্য, পরিকল্পনায় জল ঢাললাম। এই ট্রেনটা মিস করলে বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যাবে

ট্রেন আসার ১৬ মিনিট আগে টোটো চালক স্টেশনে পৌঁছে দিল দুজনে স্টেশনের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম ট্রেন আসতে দেরি দেখে ব্যাগ থেকে অংকুর সেনের ডায়েরিটা বের করলাম। ডায়েরিটা বের করার সময় ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট শাবলটা কোথাও চোখে পড়লো নাবোধ হয় ওটা বট গাছের ঝুরির অন্ধকারে ফেলে এসেছি

ডায়েরিটা পাওয়ার পর থেকে একবারও সেটা ভালো করে পরখ করে দেখিনি এখন হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ মোটা একখানা ডায়েরি বিশেষ করে কভার টা চোখে পড়ার মতো ডায়েরিটা পাওয়ার পর কতটা যে খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না ভেতরে নিশ্চয়ই অনেকগুলো গল্প রয়েছে, ভাবতেই শরীরটা কেমন উত্তেজনায় টগবগ করছে

ডায়েরির প্রথম দিকের কয়েকটা প্রিন্ট করা পাতা উল্টানোর পর দেখলাম, ১লা জানুয়ারির পাঠাতে লেখা রয়েছে মায়ের উদ্দেশ্যে সমর্পিত

হাতের লেখা সেই চিরকুটের মতো, দেখলেই পড়তে ইচ্ছে হয়। ডায়েরির প্রথম গল্প কাদোমাদো ছোটগল্প, পড়তে পড়তেই ট্রেন চলে এলো

ট্রেনে উঠে ডায়েরি পড়বি, এখন রাখ ব্যাগে ওটাবলে নন্দু ট্রেনে উঠে পড়ল

আমি ব্যাগের চেনই লাগিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠলামট্রেন ক্রমশ বাড়ির দিকে যেতে লাগলো আর আমি ডায়েরির একটার পর একটা গল্প পড়তে থাকলাম