Subscribe Us

header ads

তুমি এলে


প্রথম পরিচ্ছেদ

হাওড়া-আজিমগঞ্জ (03003) এক্সপ্রেস দাঁইহাট স্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই যাত্রীদের ভিড় লেগে গেল। অবশ্য এই ভিড় এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ানোর জন্য নয়। এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ালে সাধারণত এত খানি ভিড় হয় না। তা বলে যে এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ালে ভিড় হয় না এমনটা নয়। ভিড় হয় তবে সেটা ট্রেন যাত্রার শুরুতে, শেষে কিংবা কোনো বড়ো রেল জংশনে। বাকি স্টেশন গুলোতে খুব কম জনকেই নামতে দেখা যায় না। যদিও বা ভুল করে বেশি লোক জনকে নামতে দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে কাছে পিঠেই নিশ্চই কোনো বিখ্যাত জায়গা রয়েছে কিংবা জনবহুল এলাকা। কিন্তু এই স্টেশনটি কোনো বড়ো জংশন নয় কিংবা আশেপাশে কোনো বিখ্যাত জায়গাও নেই।

আসলে ভিড়ের কারণটা অন্য কিছুএক্সপ্রেস ট্রেন আসবার সাথে সাথেই পাশের দুই নম্বর প্লাটফর্মেও একখানি লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছিল। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই পিলপিল করে লোকজন নামতে শুরু করল, সেই সঙ্গে ট্রেন ধরবার জন্যে প্লাটফর্মে যারা বসেছিল তারাও যুক্ত হলো। দুদিকের দুই স্রোতর ধাক্কায় পুরো প্লাটফর্ম টা বুঝি নড়ে চড়েই উঠল। তবে সেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য বোধ হয় ১৫ কিংবা ২০ সেকেন্ড হবে, তারপর স্টেশন চত্বর পুরো ফাঁকা। যারা ট্রেনে উঠেছিল তারা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়েছে। আর যারা নেমেছিল তারা যে যার গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে।

দু মিনিট দাঁড়ানোর পর বিকট শব্দ করে ট্রেন ছেড়ে দিল। পরের স্টেশন কাটোয়া। ওখানে নিশ্চয়ই এখানকার চেয়ে বেশি ভিড় হবে কারণ ওটা একটা রেল জংশন তাছাড়া রেল জংশনে ট্রেন অন্যান্য স্টেশনের তুলনায় একটু বেশিক্ষণই দাঁড়ায়। সেই কারণে তুষার দাঁইহাট স্টেশনে আর নামলো না একেবারেই কাটোয়া স্টেশনে নেমে কিছু খাওয়ার আর বোতলে ঠাণ্ডা জল ভরে নেবে এই রকমই ভাবনা

মোবাইলটা বের করে সময় দেখে। সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। প্রায় উনিশ মিনিট লেট করে চলছে ট্রেন। কাটোয়া স্টেশনে পৌঁছাতে আর মিনিট পনেরো লাগবে তুষার ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। পুবের দিগন্ত ছাড়িয়ে বসন্তের মেঘ মুক্ত আকাশে আধ ফালি চাঁদটা অনেক টা ঠেলে উপরে উঠেছে। বিশৃঙ্খল ভাবে ছড়ানো নক্ষত্র গুলো মিটমিট করে হাসছে। হঠাৎ একখানি কৃত্রিম উপগ্রহ তুষারের চোখে পড়ল। ঠিক যেমন একটা নক্ষত্র তেমনি উজ্জ্বল ও ক্ষুদ্র। আকাশের উত্তর পূর্ব কোণে আবির্ভূত হয়ে ক্রমশ দক্ষিণে অগ্রসর হতে হতে এক সময় অদৃশ্য হল। আরও কি এরকম দু-একটা দেখা যাবে? তুষার ডান হাতে জানালার একখানি রড ধরে চোখ টা কে জানালার আরও কাছে নিয়ে এসে যতদূর সম্ভব ততদূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। না কোথাও কিচ্ছু নেই। শুধু কালো আকাশের বুকে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে

তুষার জানলার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে এল। আনমনে কি যেন ভাবতে লাগল। এই সময় যদি ওই মেয়েটা পাশে থাকত, তাহলে...। ট্রেনের প্রচন্ড হুইসেলের শব্দে ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল। বাইরে ভালো করে দেখে টের পেল কাটোয়া স্টেশনে মন্থর গতিতে ট্রেন প্রবেশ করছে।

দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামবার সঙ্গে সঙ্গেই তুষার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জল আর কিছু খাওয়ার নিতে তাকে ট্রেন থেকে নামতে হবে রেলিং থেকে এক গাদা ব্যাগের মধ্যে থেকে নিজের ব্যাগটা টেনে বার করে বসবার জায়গায় রাখল তারপর ব্যাগ থেকে খালি জলের বোতলটা বার করে ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামল। প্ল্যাটফর্মে ভিড় কমে গেছে নামতেই ডানদিকে খানিক দূরে কোল্ড ওয়াটার লেখা ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড তুষারের চোখে পড়ল এগিয়ে গিয়ে বোতল ভর্তি করে ঠাণ্ডা জল ভরে নিল তারপর আরও খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা দোকানে কিছু বিস্কুটের প্যাকেট, কেক ও পাঁউরুটি কিনে ট্রেনে গিয়ে বসল তার দু মিনিট পর তুষার  যখন একটা কেক সম্পূর্ন উদরস্থ করল ট্রেন তখন কাটোয়া জংশন ছেড়ে পরের স্টেশনে রওনা দিয়েছে

জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় তুষার। গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, প্রেম কেন এত কষ্টের হয়। কেনই বা কাউকে ভালোবাসলে সহজে ভোলা যায় না। ভালোবাসা যদি এত ব্যাথার হয়, কষ্টের পাহাড় যদি একজনকে চাপা দিয়ে শ্বাস রোধ করে মারতে চায়, তবে অমন ভালোবাসা কেনই বা ভগবান সৃষ্টি করেছেনসত্যি কাউকে ভালবাসলে তাকে যদি পাওয়া যেত তাহলে হয়তো ...তুষার  দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কপালে হাত দেয়এখনো মেয়েটার কিছু ছবি রয়েছে ওর কাছে। সব গুলো ডিলিট করা হয়নি। হয়তো আর কিছু মাস পর মেয়েটার আর কোনো ছবি থাকবে না ওর কাছে প্রতি সপ্তাহে একটা একটা ছবি ডিলিট করার পর আরও কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। সে গুলোই মাঝে মধ্যে বার করে দেখে। একবার ওর মনে হল একটা ছবি বার করে দেখবে কিন্তু এর পরেই মনে হল না থাক। এখন যদি মেয়েটার ছবি দেখে তবে পুরোনো সমস্ত স্মৃতি এক নিমেষে মনের মধ্যে ভিড় করে চোখের কোণ থেকে বৃষ্টির ধারা নামিয়ে দেবে। তখন নিজেকে সামলানো মুশকিল হবে। তার চেয়ে না ভাবাই ভালো। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও তুষার  নিজেকে আর তার প্রতিজ্ঞার কাছে বেঁধে রাখতে পারলো না শেষমেষ গুগল ড্রাইভ থেকে মেয়েটার একটা ছবি বার করে নিজের চোখের সামনে তুলে ধরলো এটা সেই ছবি যেটা ওই মেয়েটাই তুষার কে এডিট করতে দিয়েছিল। তুষার এডিটও করে দিয়েছিল ছবিটা। হলুদ রঙের শাড়ি, হাতে একটা ঘড়ি, গলায় মুক্তোর মালা, কান থেকে ঝুলছে তিনটে মুক্তো ওয়ালা একটা বড়ো দুল, চুল গুলো পেছনে একটা কালো ক্লিপ দিয়ে ছাড়া, আর বাম হাত দিয়ে চোখে পরে থাকা ইয়া বড়ো একটা চশমার একদিক ধরা। তুষার এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলঠোঁট টা একটু বেশিই লাল হয়তো এক গাদা লিপস্টিক লাগানোর ফলে ঠোঁটটা লাল গোলাপের মতো টকটকে হয়ে উঠেছে তুষারের  নজর সেই দিকে যেতে মনে মনে হাসতে লাগলনিজেকে স্মৃতির অতল গভীরে নিমজ্জিত করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে...

আরে আরে সর্বনাশ! কে আছো বাঁচাও, মেয়েটা যে নদীতে ঝাঁপ দিল।একজন মহিলা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো এমন ভয়ানক চিৎকারের চোটে তুষার নিজের কল্পনার জগৎ থেকে হুমড়ি খেয়ে বাস্তবে এসে পৌঁছালো ট্রেনের দরজার সামনে কিসের একটা জটলা তৈরি হয়েছে

উফ্ কিসের এত চেঁচামিচি।নিজের ভাবনায় ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই কথাটা বলল তুষার তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দরজার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল ওখানে কি ঘটেছে সেটা জানবার জন্য

ট্রেনের দরজার সামনে একগাদা লোকের ভিড় জমেছে একজন বছর পঞ্চাশের মহিলা নিচে বাইরের দিকে আঙুল দেখিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে,দেখছিলাম দরজার সামনে দাঁড়িযে অনেক্ষন বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর হঠাৎ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেয়  আমার সঙ্গে একটু আগে বেশ ভালো কথাও বলছিল, জানি না তারপর কি হলো

আরে চেন টা টানো না, কেউ একজন চেন টা টানবে তো নাকি।কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল।

একজন গিয়ে চেন টানতে ট্রেনটা পাতের উপর ধাতব শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণে ওই মহিলা কোথা থেকে একখানি কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে একটা স্ক্রিন টাচ মোবাইল নিয়ে সকলের মাঝখানে হাজির হয়েছে। এই যে তার ব্যাগ আর মোবাইল, যেখানটায় বসেছিল সেখানে ফেলে দিয়ে গেছে।

অজয় নদের ব্রিজের উপর দিয়ে আসার সময় চেনটা টানা হয়েছিল সেই কারণে চারটে কামরা ছাড়া বাকি ট্রেনটা ব্রিজ পেরিয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে আসে স্টেশন হীন নদের নির্জন তীরে হঠাৎ ট্রেন দাঁড়ানোয় যাত্রীদের মধ্যে স্বাভাবিভাবেই কৌতুহল দেখা দিতে থাকে। কিন্তু যখন আসল ঘটনা এক কামরা থেকে অন্য কামরায় ঝোড়ো হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে তখন খুব শীঘ্রই সেই কৌতুহল সবার মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায় ট্রেনের খোলা দরজা ও জানালা দিয়ে সবাই বাইরের দিকে তাকাতে থাকে কিছুজন আবার ট্রেন থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে জটলা ও পরামর্শ শুরু করে দেয়। তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক বলে উঠল আরে, কেউ একজন ঝাঁপ দিয়ে মেয়েটাকে তো বাঁচাও আগে।”

ঝাঁপ দিন আপনি।

এই বয়সে না থাক আমি যাই গিয়ে নিজের জায়গায় বসিবছর পঁচিশের এক যুবকের মুখে কথাটা শোনার পর কিছু না বলে নিজের জায়গায় চলে গেল বৃদ্ধ।

ওই দাদুর মতো আর কেউ ঝাঁপ দিতে চাইলে দিতে পারো

না না মাথা খারাপ নাকিএই অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে মরি তারপরকয়েকজন একসঙ্গে কথাটা শেষ করেছে ঠিক সেই সময় ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজল।

চলুন চলুন ট্রেন ছাড়বে যে যার জায়গায় চলুন। ওই যে স্থানীয় লোকজনেরা আসছে, ওরাই বাঁচিয়ে নেবে, চলুন।

ওদিকে ওই কামরায় ফেলে যাওয়া ব্যাগের ভেতর কি আছে না আছে সমস্ত দেখে পুনরায় ব্যাগের মধ্যে চানাল করা হয়েছে। মহিলাটির কাছ থেকে একজন মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রিনের আলো জ্বালাতেই বেরিয়ে পড়ে একটা মেয়ের ছবিস্ক্রিনটা মহিলাটির দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এই মেয়েটাই নাকি ?”

হ্যাঁ হ্যাঁ এই মেয়েটাই তো।

এই কথা শুনে সবাই আরও কাছে এসে ছবিটা দেখতে চাইলে লোকটি মোবাইলটা উপরে তুলে সবাইকে দেখাতে থাকে তুষার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধকার অজয় নদের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ মোবাইলের স্ক্রিনে নজর যেতে চমকে উঠল একে যে ও চেনে। কিন্তু…, কিন্তু এখন আর কিছু ভাবার সময় নেই দৌড়ে গিয়ে লোকটার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নিজের সিটের দিকে দৌড়ালো

নিজের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছে দেখে লোকটা তুষারের পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগল, “আরে ধরো কেউ ওকেদামি মোবাইল দেখে চুরি করার মতলব করেছে। ধরো, ধরো ওকে পালাতে দেবে না একদম।

তুষার ততক্ষণে মেয়েটার ব্যাগটা সামনের দিকে ঝুলিয়ে নিজের ব্যাগটা পেছনে ঝুলিয়েছে তারপর নিজের মোবাইলটা প্লাস্টিক পাউচের মধ্যে ভরে মেয়েটার মোবাইলটা ওই পাউচের মধ্যে ভরতে যাবে ঠিক তখনি ওই লোকটা এসে তুষারকে বগল দাবা করে ধরলকি হে ছোঁড়া চুরি করে পালানোর মতলবে ছিলে তাই না। এবার কোথায় পালাবে বাছাধন !”

ঠিক এই সময় ট্রেন ছাড়ার হুইসেলটা বেজে উঠল। তুষার ব্যাস্ত হয়ে বলল, দেখুন ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে ছাড়ুন আমার যেতে হবে। বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে

হ্যাঁ যাওয়া করাচ্ছি তোমায় চুরি করে পালানো এই ধরো তো সবাই এটাকে।

এই ব্যাগ নামা আরো কতজনের জিনিস চুরি করেছে কে জানে। ওই ব্যাগ চেক কর তো

তুষার জোর করে সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। আরে ছাড়ুন তো দেখিনি সময় নেই আমার কাছে, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে আর আপনারা দাঁড়ান আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না তো, দেখাচ্ছি দেখুন।

তুষার নিজের মোবাইলের লক খুলে ট্রেনে বসে বসে যে ছবিটা দেখছিল সেটা দেখলো। হলুদ রঙের শাড়ি পরা একটা মেয়ের ছবিদেখেছেন এবার। আমার ক্লাস মেট হয়।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছেবেশি দেরি করলে পেছনের চারটে কামরা ব্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। তুষার লোকগুলোর বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ট্রেনের পেছন দিকে জোর ছুট লাগাল। যখন দেখল আর যাওয়ার যায়গা নেই তখন ট্রেনের বামদিকের দরজা দিয়ে অজয় নদের উপর ঝাঁপ দিল। ঝাঁপ দেওয়ার আগে শুনল কেউ কেউ যেন বলছে, আরে পাগল হয়ে গেছে নাকি রে। মরবার প্রচুর শখ যে।

...