Subscribe Us

header ads

সুইসাইড


রাত বোধ হয় দেড়টা হবে। এখন নিশ্চই ট্রেনের প্রতিটা কামরায় সবাই কুম্ভকর্ণের ঘুম দিচ্ছে। আমি নিজের জায়গায় এতক্ষন ঘুমের ভান করে শুয়েছিলাম। লোকজনের কথাবার্তা থেমে গিয়ে যখন নিস্তব্ধতা আমার কানে এসে পৌঁছাল, তখন আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। শুয়ে থেকেই দেখলাম, আমার পাশের সিটের লোকটা গুটিসুটি মেরে উল্টো দিকে ফিরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। উফ্, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তবে সবাই ঘুমাচ্ছে এখন। এক মহিলা বাথরুমে গিয়েছিল, যদিও সেটা মিনিট কুড়ি আগে। এতক্ষণে নিশ্চই সেও ঘুমিয়ে গেছে। যাক গে আপাতত বিরক্ত করার কেউ নেই, নিরিবিলিতে নিজের কাজটা সারা যাবে। 

পা টিপে টিপে অতি সাবধানে নিজের জায়গা থেকে এসে দাঁড়ালাম, ডিসেম্বর মাসে ঝোড়ো হাওয়ার মতো ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেনের দরজার সামনে। দাঁড়ানো মাত্রই কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে আছড়ে পড়ল আমার উপর। কাঁপতে কাঁপতে দেখলাম, হাত পা সহ সারা শরীরের লোম গুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠছে। বাইরে তাকিয়ে দেখি, কাছে ও দূরে বিশৃঙ্খল ভাবে ছড়ানো আলোর উজ্জ্বল উৎস গুলোকে কালো দানবীয় অন্ধকার যেন গিলে ফেলতে চাইছে। একবার পেছনে ঝুঁকে ট্রেনের বামদিকে ও ডানদিকে দেখে নিলাম, নাহ কোথায় কেউ নেই। কাজটা সারার একদম উপযুক্ত পরিবেশ। 

তখন থেকে কাজ কথাটা বার বার বলছি কিন্তু কি কাজ করতে যাচ্ছি সেটাই বলা হলো না।  আর কেনই বা এটা উপযুক্ত সময় সেটাও বলা দরকার। কিন্তু তার আগে একটা সিগারেট ধরাতে হবে। কারণ এটাই বোধ হয় আমার জীবনের শেষ সিগার ধরানো হবে। 

দরজা থেকে একটু পেছনে সরে এসে সিগারেট ধরালাম।  তারপর মনের মতো একটা সুখটান দিলাম। সু সু সু, হু…। আমি মরতে যাচ্ছি। না কোনো ইয়ার্কি নয়, সিরিয়াসলি বলছি, আমি আজকে সুইসাইড করতে যাচ্ছি। বেঁচে থাকার আর কোনো ইচ্ছে নেই আমার। কেন ইচ্ছে নেই, কী কারণে সুইসাইড করতে যাচ্ছি সেসব বিষয় দৃষ্টিপাত এখন অর্থহীন। মোট কথা আমি আজকে সুইসাইড করবোই করবো। কেননা এর আগেও অনেক বার চেষ্টা করেছি কিন্তু বার বার ব্যার্থ হয়েছি। অদ্ভুত লাগছে তাই না। লোকে স্পোর্টসে ব্যার্থ হয়, প্রেমে ব্যার্থ হয়, পরীক্ষাতে ব্যার্থ হয় আর আমি কিনা সুইসাইডে ব্যার্থ হচ্ছি। সত্যি একটা হাস্যকর ব্যাপার বটে। 

যাইহোক, যদিও এসব কথা আমি কাউকে কোনোদিনও বলিনি, কিন্তু আজকে সাহস করে বলছি। এই তো কয়েকদিন আগে সামনের বুধ বারের ঘটনার কথাই যদি বলি -  সকাল সকাল হাতে একটা মোটা দড়ি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে মরবো ভেবে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে ঘন ঝোপ জঙ্গলে মধ্যে একখানি ভাঙা বাড়ি রয়েছে কিংবা তার পাশেই একটা দৈত্যাকার বটগাছ রয়েছে। যেখানেই খুশি দড়ি বেঁধে লোটকে যেতে পারতাম। কিন্তু গিয়ে যেই না বটগাছের ডালে দড়ি ছুঁড়তে যাবো, দেখি খানিক দূরে গামছা পরা অর্ধনগ্ন একটা লোক লোটা হাতে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। বোধ হয় ভাবছিল, দড়ি বেয়ে গাছে উঠে তাকে দেখতে এসেছি। তারপর আর কি, লজ্জায় পড়ে আমাকেই পালিয়ে আসতে হয়েছিল।  

এ তো গেল দড়ির ঘটনা, আরও রয়েছে। এটা বোধ হয় পনেরো-কুড়ি দিন আগের ঘটনা। সেবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরবো ভেবেছিলাম। শীত কালের দিন তাই মোটা সোয়টার আর মাফলার জড়িয়ে নদী তীরে হাজির হলাম। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। এক সময় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ঝাঁপ দিলাম নদীতে। কিন্তু সেবারও ব্যার্থ হলাম। কারণ, আমি সাঁতার জানতাম আর চেয়েও বড় কথা শীতকে আমার ভীষণ ভয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে জল থেকে উঠে জোর দৌড় দিয়েছিলাম বাড়ির দিকে।

এর আগেও বিষ, ঘুমের ওষুধ, দশ তালা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ, হাতের ধমনী কাটা আরও কত উপায় যে ভেবেছিলাম তার কোনো হিসেব নেই, কিন্তু সবেতেই ব্যার্থ হয়েছিলাম। তাই আজকে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেছি কোনো না উপায়ে মরবো ভেবে। সেই কারনে সঙ্গে বেশি কিছু নিইনি। একটা ভাঙ্গা মোবাইল ছিল সেটা বাড়িতে রেখে এসেছি। আসার পথে বৃষ্টি পড়ছিল ভিজে ভিজে এসেছি, ছাতা আনিনি। এমন কি এই শীতে সোয়টার মাফলার গুলোও পরে আসিনি, বাড়িতে রেখে এসেছি।

নাহ্ অনেক্ষন হলো আর দেরি করাটা ঠিক হবে না। লোক জন জেগে উঠলে বাগড়া দিতে পারে।

সিগারেটের শেষটুকু অন্তিম বারের মতো টান মেরে বাইরে ছুঁড়ে দিলাম।  এরপর আমার পালা, নিজেকে নিজেই ছুঁড়ে দেবো বাইরে। মুখ বাড়িয়ে ঝাঁপ দিতে যাবো ঠিক তখনই মনে হলো, ঝাঁপ দেওয়ার পর যদি প্রথমেই আমার মুখটা রেল লাইনে পড়ে তবে তো মুখটা একেবারে থেতলে যাবে, আর ব্যাথা করবে খুব নিশ্চই। না না এভাবে এভাবে ঝাঁপ দিয়ে মরবো না। অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে, অন্য উপায়।

মাথা কামড়াতে কামড়াতে নিজের জায়গায় ফিরে সিটের উপর বসে ভাবতে লাগলাম, তারপর শুয়ে পড়ে, তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু না, আধ ঘণ্টা ধরে নিজের মাথার এক গোছা চুল ছিঁড়েও কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। কী করবো, কী করা যায় ভাবছি ঠিক সেই সময়ে পাশের লাইন দিয়ে ঝোড়ো বেগে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে উল্টো দিকে মিলিয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে আমার মাথায়ও একটা দুর্দান্ত প্ল্যান এসে খেঁচা  দিল।  আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়ালাম পরবর্তী ট্রেনের অপেক্ষায়।

বেশিক্ষণ ধৈর্য্য ধরতে হলো না আমায়। দাঁড়ানোর দশ মিনিটের মধ্যেই দূরে ট্রেনের হর্ন শুনতে পেলাম। মুখ বাড়িয়ে দেখলাম দুরন্ত বেগে একটা উজ্বল আলো এগিয়ে আসছে আমাদের ট্রেনের দিকে। লক্ষ স্থির করে দরজা থেকে খানিক পিছিয়ে গিয়ে শরীরটাকে টানটান করে শক্ত করলাম। তারপর যখনই বুঝলাম ট্রেনটা প্রায় কাছে এসে গেছে তখনই দৌড়ে গিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলাম। 

পরমুহুর্তেই দেখলাম আমি শূন্যে ভেসে রয়েছি। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। চোখের সামনে সবকিছুই যেন ধির গতিতে ঘটছে। যে ট্রেনটা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলাম সেটা কেমন জানি আস্তে আস্তে চলছে। তারপর সামনে তাকিয়ে দেখতেই একটা উজ্বল আলো এসে আমার চোখটাকে ধাঁধিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা জোরালো ধাক্কা অনুভব করলাম। শিরদাঁড়া সহ পিঠের হাড় গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে শরীরটা পেছন দিকে ধনুকের মতো বেঁকে গেল। আহ্ মরে গেলাম, কী যন্ত্রনা।

দুটো ট্রেনের মাঝে আমি। আমাকে নিয়ে ওরা যেন লুফোলুফি খেলা শুরু করে দিল। দ্বিতীয় ধাক্কাটা লাগল যে ট্রেনটা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলাম তার একটা জানলাতে। ধাক্কার চোটে একটা চোখ  ফেটে গেল। নাকের হাড় ভেঙে গলগল করে রক্ত বেরাতে লাগল। দাঁত গুলো অর্ধেক খসে পড়ল। ওহ্ কি অসহ্য যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছি না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করবার চেষ্টা করেছি কিন্তু দাঁত গুলোই তো নেই।

পরের ধাক্কায় কোমর ভাঙল। ট্রেনের কোথাও একটা ডান পা আটকে যাওয়ায় হাঁটু থেকে পা টা ছিঁড়ে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল।  এরপর একটা খট শব্দ করে মাথাটা পিঠের দিকে ঘুরে শরীরটা গিয়ে পড়ল ট্রেন লাইনের উপরে। 

ধড়টা লাইনের বাইরের দিকে, মাথাটা ভেতরে আর গলাটা লাইনের উপর। কান দিয়ে রক্ত পড়ছে, তাতেই শুনতে পেলাম চাকার শব্দ। ঘাড়ের যন্ত্রনা আর সহ্য করা যায় না, হাত দিয়ে মাথাটা তুলতে যাবো ঠিক তখনই একটা চাকা এসে কুচ করে ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দিল।

এর পর আর কি, রাতে কোনো এক সময়ে শেয়াল কুকুরে শরীরটাকে টেনে ছিঁড়ে খাবে কিংবা পরের দিন লোকজনে টুকরো শরীরটাকে বস্তা ভর্তি করে কোথাও পুঁতে দেবে নয়তো জ্বালিয়ে দেবে। সব শেষ, বিদায় এ সুন্দর পৃথিবী থেকে। 


অনেকটা সময় কেটে গেছে। এক সময় অনুভব করলাম কেউ যেন আমার শরীরটাকে ঠেলছে। মনে মনে হাসলাম। বোধ হয় শেয়াল কুকুরে টানাটানি করছে কিংবা সকাল হয়ে গেছে তাই লোকজনে এসে শরীরটাকে বস্তা ভর্তি করছে। কিন্তু কি অদ্ভুত মরার পরেও কি এসব অনুভব করা যায়, কি জানি যায় বোধ হয়।  আমি আর পাত্তা দিলাম না, মরেই তো গিয়েছি আর কি। মরার পর আর কিছু থাকে নাকি ?

কিন্তু না, ঠেলছে কেউ যেন আরও জোরে জোরে ঠেলছে। ভাবলাম, একবার তাকিয়েই না হয় দেখি। কি আর দেখবো, নিশ্চই খোলা আকাশের নিচে ধড়টা দুরে কোথাও পড়ে রয়েছে। এক চোখ তো ফেটে গিয়েছে তাই অন্য চোখে তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম, কালো পোশাক পরা একজন ভুঁড়ি ওয়ালা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাঁধ থেকে ভুঁড়ির উপর দিয়ে চালিত কালো ফিতে লাগানো একটা কালো ব্যাগ ঝুলছে। আমাকে এক চোখে তাকাতে দেখে বাজখাঁই গলায় বলল, “এই উঠো উঠো, ফাজলামি পেয়েছো তখন থেকে ডাকছি শোনা যাচ্ছে না। দেখি টিকিট দেখি, টিকিট।”

আমি দাঁত বের করে বললাম, “হি হি, মরা মানুষের আবার কি টিকিট!”

আমার এই কথা শুনে লোকটা আমাকে অফিসে ধরে নিয়ে গেল। অফিসে পৌঁছে বুঝলাম আমি মরিনি বেঁচে আছি। পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখাতে টিকিট দেখে টিটি বলল, “পাঁচশো টাকা ফাইন দিতে হবে।”

আমি তো অবাক, “পাঁচশো টাকা! কি কারনে?”

টিটি মুখে কিছু বলল না শুধু একবার গোখরো সাপের মতো ফোঁস করে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে স্টেশনের নাম দেখে বুঝলাম যতটা রাস্তা আসবো ভেবে টিকিট কেটেছিলাম তার তিন গুণ রাস্তা চলে এসেছি। ফাইন নেওয়ার কারণ জেনে গিয়েছি আর আমার কাছে ফাইন দেওয়ার টাকাও নেই, মাত্র দশ টাকা পড়ে আছে তাই ঢোক গিলে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মরতে গেলে লোকে কি আর লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে মরতে যায়।

কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে টাকা নেই দেখে আমাকে ছেড়ে দিল ওরা। বাড়ি ফিরবো টাকা নেই, ফেরারও ইচ্ছে নেই। তাই আবারও পরিকল্পনা করতে থাকলাম মরবার। স্টেশন থেকে বেরিয়ে পিছের রাস্তায় এসে দাড়ালাম আর সম্মুখীন হলাম এক নির্মম বাস্তবতার। তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে ভাঙ্গা চোরা ঠেলা গাড়িতে বোধ হয় তার জন্মদাতা পিতাকে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে আমার সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়ালো। ঠেলাতে বসে থাকা লোকটার দুটো পা হাঁটু থেকে কাটা। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। বুকটা যেন আমার কেঁপে উঠল। নিজের অজান্তেই আমার হাত চলে গেল বুক পকেটে। পকেটে মাত্র দশ টাকা। সেটাই বের করে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “এটাই রয়েছে আমার কাছে আর নেই।”

করুণ ক্ষুধার্থ মুখে একটি ধন্যবাদের হাসি দিয়ে মেয়েটা টাকাটা নিজের হাতে ধরলো। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। সঙ্গে আমায় দিয়ে গেল বেচেঁ থাকার এক অভাবনীয় শক্তি।