Subscribe Us

header ads

শেষ দেখা

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুশীল, দিগন্তের নম্বরটা ডায়েল করে কানে তুলে নেয় মোবাইলটা। রিং হতে থাকে। একটু পরে ওদিক থেকে কথা ভেসে আসে, “আরে চলে এসেছি, বেশি দেরি নেই। এইতো আর আধ-ঘন্টা মতো লাগবে।”

Picture collected from Internet

সুশীল একটু রাগ দেখিয়েই বলে, “তখন থেকে তিনবার ফোন করলাম, সেই আধ ঘন্টা ছাড়াতো আর কিছুই শুনছি নাএদিকে সবাই চলে এলো, আর তোর টিকি-টারও দেখা নেইকটা বাজে সেটা খেয়াল আছে তো? সে নাকি আবার সবাইকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিল।”

তার কথা শেষ হতেই দিগন্ত একটু মুচকি হাসে, “হুম্!”

সুশীল একটু বিরক্তির ভঙ্গিতেই বলে কথাটা, “ট্রাইপোর্ডটা নিয়ে আসছিস তো সঙ্গে করে, নাকি ভুলে বসে আছিস আসল কাজটাই হবে না ওটা না হলে।”

হাসির সঙ্গে ওদিক থেকে ভেসে আসে কথা গুলো, “আরে বাবা, নিয়ে যাচ্ছি এত চাপ নেয় না ছেলেটা।”

কি জানি, বিশ্বাস তো হয় না যে ভাবে আধ ঘন্টার গল্প শোানাচ্ছিস…।”

সুশীলের শেষের কথা গুলোয় আর কান দেয় না দিগন্ত, মৃদু কন্ঠেই বলে উঠে, “বলছি, সবাই চলে এসছে না!”

এমন ভাবে সে বলে কথা গুলো, যেন বিশেষ কিছু অর্থ লুকিয়ে ছিল তার মধ্যেঠিক এমনটাই, যেন বিশেষ কিছু জানার আগ্রহ তাকে ব্যাকুল করছিল

ওসব সুশীল কিছু বুঝলো নাসে সাদামাঠাই উত্তর দিল, “হ্যাঁ, প্রায় বেশির ভাগই চলে এসছে।”

সবাই এসছে না!” আরও ক্ষীন কন্ঠে বলে উঠে দিগন্ত

আরে বাবা হ্যাঁ উফফ্!

আর, সে ?”

সুশীল একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করে, “সে মানে?”

কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারে না দিগন্ত

ও কি বলতে চাইছে, কিছুটা আন্দাজ করতে পারে সুশীল খুব স্বাভাবিক স্বরেই বলে, “তুই কি ওর কথা বলছিস?”

ওদিক থেকে কোনো উত্তর আসে নাসুশীল বলে, “হ্যাঁ,এসছে মনে হয়।”

কি যেন বিড়বিড় করতে থাকে নিজের মধ্যে দিগন্ত

ওর কথায় এতটা খেয়াল না দিয়েই সুশীল জিজ্ঞাসা করে, “কিসে আসছিস, বাইকে নাকি ?”

হুম্কি যেন ভাবতে ভাবতে সুশীলের কথার উত্তর দেয় দিগন্ত

ঠিক আছে আর বেশি কথা বলতে হবে নাবাইক চালাচ্ছিস, ফোন রাখ।” বলে ফোনটা কেটে দেয় সুশীল

কলটা কখন কেটে গেছে বুঝতে পারে না দিগন্তউদাস মনে কী যেন ভাবতে থাকেআবার কতদিন পর দেখাপাঁচ বছরএতদিন হয়তো দিগন্তকে মনেও নেই ওরদেখা হলে, দিগন্তের সঙ্গে আদেও কথা কি বলবে ওনাকি সেই আগের মতোই আড়াল থেকেই দেখতে হবে তাকেসেই ক্লাস টেনের মতোতারপর ইলেভেন, টুইলভসেই একইভাবে দেখে আসাঅনেকবার চেষ্টা করেছে, এবার ওকে বলে দেবে ওর মনের কথাটাকিন্তু,এই লাজুক মুখচোরা ছেলেটাকে সারাক্ষণ তাড়া করেছে কোনো এক অজানা ভয়সে ভয়ের কারণ ও বুঝতে পারে না, আবার বলাও হয়ে উঠে নাস্কুলে থাকতে আর বলা হয়ে উঠেনি তারপর কলেজ, দূরত্বটা অনেকটা বেড়ে যায়তাই সে মাঝে মধ্যেই হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে আসেযদি বাসস্ট্যান্ডে বা রেল স্টেশনে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, ও তো সেই পথ দিয়েই কলেজে যায়তাহলে সে তখন একবার মন ভরে দেখতো ওকেকিন্তু এমনটা কোনো দিনও হয়নি আজ হয়তো স্কুলের পুরোনো স্মৃতির হাত ধরে সেই দিন আসবে

আজকে ওদের স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে হীরক জয়ন্তী উদযাপন হচ্ছে সেই উপলক্ষে স্কুলের তরফ থেকে প্রাপ্তনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আর দিনের সমস্ত টুকরো মূহুর্ত গুলোকে ধরে রাখতেই ক্যামেরা ও ট্রাইপোর্ড এর ব্যবস্থাআর তার দায়িত্বে পড়েছে ট্রাইপোর্ড অনার ভার

ভাবনায় ছেদ পড়ে অনেক্ষন থেকেই একটা লরি হর্ন দিচ্ছে পেছনেদিগন্ত ওর বাইকের স্পিডটা একটু বাড়িয়ে নিয়ে আবার পুরোনো ভাবনায় ডুবে যায়

 

ফোনটা পকেটে চালান করে সামনের গেটের দিকে তাকায় সুশীলশান্তনু আর সুবর্ণ আসছেতার কাছে আসতে শান্তনু জিজ্ঞাসা করে, “কিরে এখানটায় দাঁড়িয়ে কি করছিস, চল

আরে তোমার জন্যই তো দাঁড়িয়ে আছি শান্তনুদাসুশীলের কথা শুনে ওর পিঠে একটা হালকা চাপড় মেরেআচ্ছাবলে খিক খিক করে হেসে উঠে শান্তনু।                                                      

সুশীল জিজ্ঞাসা করে, “কিরে সুবর্ণ, ক্যামেরা নিয়ে এসছিস? আর কি অবস্থা হয়েছে তোর এটা, ভুড়ি হচ্ছে যে।” বলে ভুড়িতে একটা অভদ্র চাঁটি মেরে হা-হা করে হেসে উঠে

একটা বিরক্তি সূচক শব্দের পর দাঁড়াতোবলে পেট থেকে সুশীলের হাতটা সরিয়ে দেয় সুবর্ণপেছনের দিক থেকে ক্যামেরাটা সামনে নিয়ে আসে সুবর্ণএতক্ষণ সেটা পেছনে থাকায় সুশীল ওটা দেখতে পায়নি এখন চোখ যেতে, “আরে এত বড়ো ক্যামেরা!” বলার আগেই তার গলায় ঝুলিয়ে দেয় সুবর্ণ ওটাকে

চল এবার ওদিকটাতে যাইবলে সামনে পা বাড়ায় সুবর্ণ

 

অনেকেই বসেছিল চাতালটার উপর গোলগাল একটা আম গাছের চারপাশ গোল করে বাঁধানো পাকার চাতাল সবাই নিজেদের মধ্যে গল্পের খোশমেজাজে ডুবেছিলতা তো হবেই, অনেক দিন পর সবার সঙ্গে দেখা বলে কথাকেউ আর সেই আবেগকে ধরে রাখতে পারছে না

গেটের দিক থেকে অনেকেই আসছেকেউ কেউ এসে চতালটার উপর বসছে, কেউ আবার স্কুলের চারপাশ ঘুরে ফিরে দেখছে ওরা এসে চাতালটার উপর একটু জায়গা করে নিয়ে বসে পড়েসুবর্ণ ক্যামেরাটা সুশীলের কাছ থেকে নিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখেপকেট থেকে মোবাইলটা বার করে স্কুলের পুরানো ছবি গুলো দেখতে থাকেশান্তনুও ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে ছবি গুলো

হঠাৎ একটা ছবি দেখে শান্তনু, “এটা তো ওই মঞ্চের।”

পুরো কথাটা শেষ না করে স্কুলের সাংস্কৃতিক মঞ্চটার দিকে তাকায়তারপর ওই দিকে তাকিয়েই বাকি কথাটা শেষ করে, “হায়, ওই ঘড়িটা তো আর নেই, তার জায়গায় লাগানো একটা ডিজিটাল ঘড়ি।”

হুম্, তাই তো দেখছিসুবর্ণও সেই দিকে তাকিয়ে বলে উঠে কথাটা

সুশীল এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়েছিলওদের কথাবার্তা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ওদের দিকেএকবার ওই ঘড়িটার দিকে তাকায়, তারপর শান্তনুর উদ্দেশে বলে, “ওহ্ ওইটা, ওটাতো আজ দেড় বছর হয়ে গেল পাল্টে দিয়েছেকি একটা গন্ডগোল হয়েছিল তাই।”

স্কুলটা আগের চেয়ে অনেকটা পাল্টে গেছেবলে আবার মোবাইলের ছবি গুলো দেখতে থাকে শান্তনু

 

প্রতিদিনের চেনা কোলাহল-কে ছাপিয়ে নতুন এক ব্যাস্ততার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেমাইকে বেজে চলা সুমধুর রবীন্দ্র সংগীত ফুরফুরে শান্ত বাতাসকে মাতিয়ে তুলেছে

মেইন বিল্ডিং-এ প্রবেশ করার পাঁচটি ছোটো ছোটো গেট সহ আরও ছোটো বড়ো প্রতিটা গেটকেই ফুল দিয়ে খুব যত্ন করেই সাজানো হয়েছেস্কুলে ঢুকতে বামদিকে একটা মাঝারি ধরনের গেট দিয়ে সোজা তাকালে একটা কমপ্লেক্সের মতো চোখে পড়েতার পেছনে একটা মঞ্চ, তারও পেছনে রয়েছে সাজঘরআসলে ওটাকে ঠিক সাজঘর বলা চলে নাওটা একটা ক্লাসরুম, শুধু অনুষ্ঠানের সময় ওর নামটা পাল্টে যায়এখন ওখানে কিছু কাজ হচ্ছে, মঞ্চ সাজানোর কাজখানিক পরে ওখানে কিছু অনুষ্ঠান শুরু হবেরাতের দিকেও কিছু অনুষ্ঠান রয়েছেআর তার জন্যই এতসব লাইট-মাইক খাটানোর তড়িঘড়ি

গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে লাবন্যপকেটে মোবাইলটা বেজে উঠেছে

ওকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে, “কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে পড়লি যে?” বলে তন্ময়ও দাঁড়িয়ে পড়ে

পকেট থেকে মোবাইলটা বার করতে দেখে আর রিং হতে শুনে, তন্ময় বুঝতে পারে তার দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণটালাবন্য কলটা রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে আসে মোবাইলটাহ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের চেয়েও দ্রুত বেগে ওপাশ থেকে কিছু কথা এসে ওর কানে ধাক্কা দেয়

লাবন্য তার কথার উত্তরে বলে, “আরে গেটের সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছি।”

বোধ হয় ওদিকের বাকি কথা শেষ হতেই, “আচ্ছা রাখবলতেই কলটা কেটে যায়

এদিকে কখন সুজিত এসে তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছে

কে ফোন করছিল?” লাবন্যকে জিজ্ঞাস করে তন্ময়

লাবন্য কিছু বলার আগেই, “সুশীল মনে হয়।” বলে সুজিত এর-ওর দিকে তাকাতে থাকে

লাবন্য তার মাথাটাকে উপর নীচ করে। “ওই, কতদূরে আছি ওটাই জিজ্ঞাসা করেছিল।” বলে ফোনটাকে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে, “চল এবার ভিতরেবলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়

 

চারিদিকে এত ভিড় যে সাইকেল রাখবার জায়গা টুকুও নেইঅনেক কষ্টে একটু জায়গা করে সাইকেল গুলো রেখে বাইরে বেরিয়ে আসছে, এমন সময় সামনে একজন স্কুলের স্যারের সঙ্গে দেখাস্কুলে অনেক নতুন স্যার এসেছেন যাদের সবাইকে ওরা চেনে নাকিন্তু ইনি তাদের মধ্যে কেউ ননএনাকে ওরা চেনেওদের সময়কার-ই একজন স্যার

কি রে তোদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে?” স্যার জিজ্ঞাসা করেন

না স্যার এইমাত্র এলাম।”

আচ্ছা তবে ওদিকে চলে যা, খাওয়া-দাওয়া করে নে।” বলে ডাইনে একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে খুব ব্যাস্ততার সঙ্গে চলে যান

এত তাড়াতাড়ি আরম্ভ হয়ে গেছে?” অবাক হয়েই সুজিত প্রশ্নটা করে

তা হবে না, কম জনের আয়োজন নাকি।”

 

কথাটা বলা শেষ করে যখন তন্ময়রা আম গাছটার তলায় আসে তখন ঘড়িতে বাজে সোয়া এগারোটাওখানে পৌঁছে লাবন্য সুশীল কে জিজ্ঞাসা করে, “কই তোদের কি সব ভিডিও আর ছবি-টবি তোলা হবে যে কি ব্যাপার।”

সামনে রাখা ব্যাগটার দিকে নজর যেতে। “এই তো ক্যামেরা এসে গেছেআর ট্রাইপোর্ড-টা চলে এলেই হলো।”

লাবণ্যের কথায় একটু খোঁচা দিয়েই বলে সুশীল, “হ্যাঁ সে তো আধঘন্টা-আধঘন্টা করে আসছে।”

ওটা তো দিগন্ত নিয়ে আসবে বলছিল না! সে কোথায়? এখনও তো আসেনি দেখছি ফোন করে দেখ না একবার।” বলে সুশীলের পিঠে একটা আলতো ঠেলা দেয় লাবন্য

ততক্ষনে ওরা সবাই আমগাছটার তলায় জড়ো হয়ে বসেছেচারিদিকের ভিড়-ভাট্টা আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছেউপরে থাকা মস্ত ডিজিট্যাল ঘড়িটা ক্ষণে-ক্ষণে সবাইকে সময় বাতলে দিচ্ছেমঞ্চে এখন নজরুল গীতি পরিবেশন করছে ক্লাস নাইনের একটি মেয়েখানিক আগে সভাপতির ভাষণ দিচ্ছিলেন স্কুলের মাননীয় প্রধান শিক্ষক মহাশয়অনেক দূর পর্যন্ত প্যান্ডেল খাটানো হয়েছেতার নিচে বসেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাআর তার পর-পরই রয়েছে স্কুলের প্রাপ্তন ছাত্রছাত্রীরা

আকাশে সূর্যের আলো মাঝে মধ্যেই আবছা হয়ে আসেদু-একটা টুকরো মেঘ আড়াল করে যায় জ্বলন্ত সূর্যকেআর তাদের অস্পষ্ট ছায়া উত্তপ্ত ধুলি মেশানো বালিকণার উপর দিয়ে এলোমেলো ভাবে ছুটে বেড়াতে থাকে

সুবর্ণ এতক্ষন ওই দিকেই তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলহঠাৎ করেই লাবন্যর শেষ কথা গুলো ওর কানে আসতে তার ভাবনায় ছেদ পড়েআচ্ছা তুই একবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করে দেখ, কতদূরে আছে ও।” খুব নিচু গলায় কথাটা শেষ করে আবার সেই ছায়া গুলোর দিকে তাকিয়ে পুরনো ভাবনায় ডুবে যায়

লাবন্য ততক্ষণে দিগন্তের নম্বরটা বার করে ডায়েল করেছেলাউড স্পিকারটা অন করতে করতে লাবন্য, “সে তো আমাকে সকালেই ফোন করেছিলোদেখি এখন কত দূরে আছে।” ওর কথা শেষ হতেই মোবাইল থেকে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “আপনি যে নম্বরে কল করেছেন সেটি এখন সুইচ-স্টপ রয়েছে।”

দেখ, মোবাইলটা সুইচ-স্টপ করে রেখে দিয়েছে।” সুশীল এর কথা শুনে তুষার নিজের একটা প্রস্তাব পেশ করে বলে, “আচ্ছা তবে আগে খাওয়াটা সেরে নিলে হতো না! খিদেও পেয়েছে।”

খাওয়ার কথা শুনে সুজিত হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে ডান হাতটা পেটের উপর এনে গোল গোল করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, “হ্যাঁ রে চল খেয়ে নিই।”

খাওয়ার পর কে থাকবে না থাকবে তার ঠিক নেইযা হবে সব খাওয়ার আগে।” একটু মেজাজ দেখিয়েই কথাটা বলে সুবর্ণ

তন্ময় এতক্ষন চুপচাপই ছিল হঠাৎ, আচ্ছা তবে একটু স্কুল মাঠের দিক থেকে ঘুরে আসা যাক নাকি! ওই দিকটাতে অনেক দিন যাওয়া হয়নি।”

হ্যাঁ তা করলেও মন্দ হয় না বলে ক্যামেরা রাখা বাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে মাঠের দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরে সুবর্ণ

লাবন্য নিজের মোবাইলটা পকেটে রেখে, সুশীলের মোবাইলটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, “সারাক্ষণ পাবজি! রাখ না মোবাইলটা।”

তার কথায় তাল মিলিয়ে শান্তনুও বলে উঠে, “হ্যাঁ রাখ নাশুধু পাবজি।”

তুমিও কম কিসে শানু বাবু বলে মুচকি হেসে রাজেশও হনহনিয়ে বাকিদের পিছু নেয়

বাকি থাকে আর তিন জন, শান্তনু লাবন্য আর সুশীলআর বাকিরা অনেকটা এগিয়েছে                                                                                                                                                                                                

লাবন্য মোবাইলটা দিলে,ওটাকে পকেটে রেখে শেষ বারের মতো একবার গেটের দিকটা দেখে নিয়েই মাঠের দিকে রওনা দেবেসেই মতোই ভেবে নিয়ে সুশীল মোবাইলটা লাবন্যর কাছ থেকে নিয়ে পকেটে রাখেগেটের দিকটা শেষ বারের মতো একবার দেখে নিয়ে সামনে পা বাড়ায়কিন্তু পা আর এগোয় না ওরলাবন্য আর সায়ক ততক্ষণে একটু এগিয়েছেওর মনে হল চেনা কেউ একজনকে দেখছেসে ওর সহপাঠী বা অন্য চেনা কেউ কিংবা যাকে চাইছে সেও হতে পারে কৌতুহলকে আর চেপে না রেখে সুশীল ঘাড় ফিরে পেছনে তাকায়সত্যি, ও যা ভেবেছিল তাইদিগন্ত আসছে গেটের দিক থেকেহাত থেকে একটা ব্যাগ ঝুলছেসম্ভবত ওটাতেই ট্রাইপোর্ড টা আছেপোশাকের এত জৌলুস নেই, সাদাসিদে পোশাক, যেমনটা ও পরতে ভালোবাসেচুলটা হয়তো যত্ন করেই আঁচড়ানো হয়েছিলো কিন্তু এখন তা একটু এলোমেলো হয়েছেহাসি মুখ করে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে

কাছে আসতে সুশীল ওকে একটু খোঁচা দিয়েই জিজ্ঞাসা করে, “তাহলে শেষমেশ আধ ঘণ্টায় চলে এলি নাকি?”

ধনঞ্জয়ের কথা শুনে দিগন্ত শুধু একটু মুচকি হাসে

আর তুই যে বাইকে আসছিলি কই বাইক নিয়ে ঢুকতে দেখলাম না তো তবে কি তুই বাইকটাকে গেটের।”

আরে নাপ্রায় এসেই পড়েছি হঠাৎ করে বাইকটা বিকড়ে গেলকি আর করিকাছেই একজনের বাড়িতে ওটাকে গছিয়ে দিয়েই একটা টটো তে করে চলে এলামএই নে তোর ট্রাইপোর্ডআর বাকিরা গেল কোথায়?”

দিগন্তের হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বাকিরা সবাই কোথায় কেন সব কিছু বৃত্তান্ত ওকে জানায়দিগন্ত সবটা শুনে। তারপর বলে, “চল, তবে কাজটা সেরে নেওয়া যাক নাকি

কাজটা, কি কাজটা?” অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করে সুশীল

তখন ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম যে তোকে, ও এসছে কিনাতুই বললি এসছেতো যাই গিয়ে একটু দেখা করে আসি।”

কি করবি দেখা করে তুই? না-না বল দেখা করে কি করবি? প্রপোজ করবি? তুই প্রপোজ করলেও ও তোকে না বলে দেবে তবে।”

জানি

জানিস!” অবাক হয়েই কাথাটা বলে উঠে সুশীলতারপর কৌতুহলের সঙ্গে ওকে জিজ্ঞাসা করে, “তবে কি তুই কখনো ওকে বলেছিলি।”

বলেছিলাম, হোস্টেলে যাওয়ার আগেতখন কলেজ শুরু হয়নিও তখনই না বলে দেয়বড্ড ভালবাসতাম মেয়েটাকে।” বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে

শেষের কথাটা না বললেই চলতোকারণ সুশীল জানে দিগন্তের চেয়ে হয়তো আর বেশি কেউ ওকে ভালোবাসতে পারবে নাতাই আর সুশীল কিছু বললো নাচুপচাপ থাকলো

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সুশীল বলল, “আচ্ছা, তুই জানিস আজ ছয় মাস হয়ে গেল ওর বিয়ে হয়ে গেছেএর পরেও কি তু।”

জানি

এটাও জানিসতবে কেন তুই ওর সঙ্গে দেখা করবি? আমি দেখা করতে দেবো না তোকেআমি চাই না তুই আর কষ্ট পাস।”

কষ্ট” কথাটা বলে দিগন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেতারপর সুশীলের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা, তুই কি জানতিস যে ওর স্বামীর হাটের প্রবলেম ছিল।”

কই না, এটা তো জানতাম না।”

আমিও জানতাম নাএকটু আগেই জানতে পারলামওর স্বামী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেডাক্তাররা বার বার করে বলে দিয়েছেন খুব শীঘ্রই অপারেশন টা করিয়ে নিতে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে হার্টের সন্ধান কোথাও মিলছে না আর আজকের মধ্যে যদি হার্ট Transplant না করানো হয় তবে নাকি আর বাঁচানো যাবে না।”

হুম্ খুব খারাপ সংবাদ কিন্তু, তোর মাথায় আবার ওই হিন্দি ফিল্মের ভুত চাপলো না তোকি জানি - ওকে ভালোবাসি, ওর দুঃখ আমি দেখতে পারবো না - বলে ফস করে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের বুকের বামদিক টা হয়তো খালি করে দিলিএসব ভুল ভাল চিন্তা একদম মাথায় আনবি না

সুশীলের কথা শেষ হওয়ার আগেই দিগন্ত প্রায় হেসেই গড়িয়ে পড়ে। “ওহ্ তুই যে কি বলিস না হাসি থামছে না আমার তোর কথা শুনে।”

অনেক কষ্টে হাসিটাকে থামিয়ে নিয়ে দিগন্ত বলল, “আচ্ছা চল, কথা না হোক আপাতত দেখাটা তো করে আসিআজকে দেখা করাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি।” দিগন্তের এই শেষের কথাটা শুনে সুশীলও একটু অবাক হয়ে তার দিকে ভালো করে তাকায়কেননা আগের কথা  গুলোর মধ্যে হাসি মাখানো থাকলেও শেষের কথায় মাখানো ছিল এক উষ্ণ গাম্ভীর্য

দিগন্ত ধনঞ্জযের বাধা অমান্য করে খেলার মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়সুশীলও তার পিছু পিছু এগিয়ে যায় কিন্তু কি যেন দেখে এক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ায়ও দেখেছে দিগন্তের মাথা থেকে একটা রক্তের দাগ কানের পেছন দিক হয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকেতৎক্ষণাৎ ও দিগন্তের কাছে দৌড়ে যায়জিজ্ঞাসা করে, “তোর মাথায় এতো রক্ত এলো কোথা থেকে?

কথাটা শুনে দিগন্ত প্রায় চমকে উঠেতারপর চোরের মতো পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে রক্তটা মুছে নেয়সুশীলের নজর এড়ায়নি, ও দেখেছে রুমালে আগে থেকেই রক্ত লেগেছিল।  

আরে তেমন কিছু নয়ওই টটো তে যখন উঠছিলাম মাথাটা উপরে ঠেকে গিয়েছিলওখানেই চোট লেগে রক্তটা বেরিয়েছে হয়তো।”

তা বলে এত রক্ত? চল ডাক্তারের কাছে যাই।”

আরে তেমন কিছু হয়নিআগে চল প্লে গ্রাউন্ডে যাইবাড়ি গিয়ে আমি ডাক্তার দেখিয়ে নেবো।” বলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়

আরে শোন, আরে…! একটাও কথা শোনে নাবলছি ডাক্তার দেখাতেওনার বাবু..।” সুশীল গজগজ করতে করতে ওর সঙ্গ নেয়তারপর একসঙ্গে দুজনে খেলার মাঠে পৌঁছায়

 

মাঠে পৌঁছে দুজনের চোখ তো ছানাবড়াওরা দেখলো অধিকাংশরাই রয়েছে এই খেলার মাঠেই স্কুলের মঞ্চের সামনে তো গুটি কয়েকজন বসে মাত্র, বাকিরা তো এখানে সবাই এখানে ওখানে দল বেঁধে গোল হয়ে সবুজ নরম ঘাসের উপর বসে গল্পের মেজাজে মত্তকেউ কেউ আবার জোড়ায় জোড়ায় বসেছে

সুশীল তো দেখেই অবাক, বাঃ বাঃ দেখেছিস কি সব ব্যাপার।”

দিগন্ত বুঝতে পারে সুশীল কেন একথা বলছে তাই ও তার মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “আমি একজনকে খুঁজছি, তুই একটু সাহায্য করলে ভালো হয়।”

হ্যাঁ নিশ্চই।”

ওহ্! পেয়েগেছি।”

কোথায়?” বলে সুশীল এদিকে ওদিকে মাথা ঘোরাতে থাকেতারপর দিগন্তকে সামনের দিকে যেতে দেখে ওর পিছু নেয়

সামনে রয়েছে একটা বিশাল পুকুরওদের সময়ে পুকুরটা এত বড়ো ছিল নাখুব সম্ভবত কয়েক বছর আগেই পুকুরটাকে কেটে বড়ো করা হয়েছেপুকুরে নামবার জন্য রয়েছে একটা পাকার সিঁড়িএটাও খুব হালে হালেই তৈরি করা। সিঁড়ি যেখানে শুরু হয়েছে তার আগেই রয়েছে দুদিকে বসবার জন্য দুটো বেঞ্চির মতো সেখানে বসে রয়েছে সুশীলের চেনা কয়েকজন বন্ধুসুশীল ওদের কাছে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে পড়েআর দিগন্তকে ওদের থেকে একটু দুর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে

সুশীলকে কাছে এসে বসতে দেখে লাবন্য জিজ্ঞাসা করে, “কি রে তোর আসতে এতো দেরি হলো যে?”

আরে, তোদের চলে আসার পর দিগন্ত এল, ওর সঙ্গেই কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল আরকি।”

তা দিগন্ত কোথায়?” শান্তনু জিজ্ঞাসা করে

ও কার সঙ্গে যেন একটা দেখা করতে গেল।”

এমনিতেই দেরি করে এলো, তারপর আবার কার সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলএভাবে চলতে থাকলে সময়ের মধ্যে সব কাজটা হবে কি করে বলতো? কটা বাজে বল দেখি, সাড়ে বারোটা বাজতে চললো, ধুর।” একটু বিরক্ত হয়েই কথাটা বলে উঠে সুবর্ণ

সুশীল ততক্ষনে ঘাড় ফিরিয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়েছেসুশীল দেখল দিগন্ত ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পুকুর পাড়ের একটা ছোটো বটগাছের দিকেবট গাছের গুড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী মূর্তিসম্ভবত ফোনে কারুর সঙ্গে কথা বলছেবটগাছের ডালপালা গুলো নিচের দিকে ঝুলে পড়ায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে নাকিন্ত সুশীল জানে সে কেদিগন্ত গিয়ে সেই নারী মূর্তির পেছনে দাঁড়ালকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলতারপর যেন আচমকাই ঘটনাটা ঘটে গেলসম্ভবত দিগন্তের বলা কিছু কথাতে নারী মূর্তি পেছনে ফিরে তাকাল আর সঙ্গে সঙ্গে নারী মূর্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল

ঘটনার আকস্মিকতায় সুশীল যেন কিছু ক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল মনে মনে ভাবতে থাকল, ‘যে দিগন্ত ওই মেয়েটাকে এতো ভালোবাসতো, সেই চোখের সামনে মেয়েটাকে পড়ে যেতে দেখেও ধরলো না কেন? নাকি দিগন্তও বুঝতে পারেনি এমনটা ঘটবে বলে।’ এতসব ভাববার সময় নেই এখন, বলেই সে চিৎকার করে উঠলো, “আরে আরে, কি হল! কি হল!”

ওর চিৎকার শুনে সবাই তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারলআর সঙ্গে সঙ্গে সবাই বট গাছের নিচে উপস্থিত হল ওদের আগেই ওখানে দু-তিন জন এসে জড়ো হয়েছিলওদের মধ্যে একজন ওর চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে ওর জ্ঞান ফিরে এলোতারপর উঠে বসতে সুশীল ওর একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “দিগন্ত তোকে কি এমন বলল যে তুই একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলি।” সুশীল দেখলো, অসুস্থতার বাহানা দিয়ে সে তার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে

তারপর দুজন মেয়ে ওকে ধরাধরি করে স্কুলের ভেতরে নিয়ে গেলএতসব কিছুর মধ্যে সুশীল দিগন্তকে ওখানে একবারও দেখতে পেল নাশান্তনুকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, সে দেখেনিআরও দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করার পর যখন শুনল যে কেউই দেখেনি ওকে, তখন দিগন্ত ভাবল হয়তো সে বাড়ি চলে গেছেমাথায় চোট লেগেছিল তো, সেই কারণে ডাক্তার দেখাবেকিন্তু একবার ফোন করে দেখা উচিত, যেভাবে রক্ত বেরাচ্ছিলভেবে সুশীল দিগন্তকে ফোন করে কিন্তু ওর ফোন সুইচ-অফ বলেওর বাড়িতে ফোন করা যেতেই পারতো কিন্তু দিগন্ত সুশীলকে বলেছিল ওদের বাড়িতে কেবল ওর একারই ফোন রয়েছেঅগত্যা, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরবার সময় একবার দেখা করে আসতে হবে

তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে গ্রুপ ছবি তুললোকেউ একা একা ছবি তুললোকেউ আবার জোড়ায় জোড়ায় তুললোএখানে তুললো, ওখানে তুললো, কতশত যে ছবি তোলা হল তার ইয়ত্তা নেইসবশেষে দুপুরের সুস্বাদু ভোজে নিজনিজ উদর পরিপূর্ণ করে কেউ কেউ বাড়ি চলে গেল, আবার কেউ কেউ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান দেখার জন্য থেকে গেল

 

তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে সাতটা-পনেরো বেজেছেপ্রকাণ্ড ডিজিটাল ঘড়িটা যেন এক লাল রাক্ষসে পরিণত হয়েছেআর তার গোল গোল লাল দুটো চোখ দপ দপ করতে করতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আকার আয়তন পরিবর্তন করে নিচ্ছে

দিনের বেলায় যে মঞ্চটাতে সবকিছু অনুষ্ঠান চলছিল এখন সেখানটায় ফাঁকাশুধু একটা ছেলে বসে আছে চেয়ারের উপরসামনে একটা টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে কিছু পুরস্কারের সামগ্রীপুরস্কার বিতরণ করবার সময় যারা পুরস্কার নিতে আসেনি এখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ এসে নিজের নাম জানিয়ে পুরস্কার নিয়ে যাচ্ছেযে মঞ্চটাতে লাইট-মাইক খাটানো হচ্ছিল দিনের বেলাতে, সেখানটায় এখন শুরু হয়েছে নৃত্যানুষ্ঠান নৃত্যানুষ্ঠানের পরের মঞ্চস্থ রয়েছে নাটক মঞ্চের সামনে বৃহৎ একটা আসনের উপর বসেছে সবাইভিড় তেমন নেই, তাই সুশীল হাত পা ছড়িয়ে বসেছিলওর কাছেই বসেছিল লাবন্য আর সুবর্ণওদের ব্যাচের বাকিরা প্রায় সবাই বাড়ি চলে গিয়েছেথাকার মধ্যে শুধু দু-চারজন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে

সুশীল নিজের হাত ঘড়িটার দিকে তাকায়সাতটা বেজে কুড়ি মিনিটবাড়ি যাবে বলে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়েতাকে উঠতে দেখে সুবর্ণ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কি হলো এর মধ্যেই চলে যাবি?

আসনের উপরে রাখা ট্রাইপড সহ ব্যাগটাকে হাতে তুলে নিয়ে সুশীল বলল,“হ্যাঁ রে একটু তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে, ওই দিগন্তের বাড়ি হয়ে যাবো তো তাই

দিগন্তের অসুস্থতার ব্যাপারটা ওদের আর জানালো না সুশীলকারণ ও জানে এখনই একথা বললে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সময় কাভার হয়ে যাবে

শান্তনু বলল, “আজকে কই দিগন্তকে একবারও দেখতে পেলাম না।”

দেখিসনি? আরে, আমরা যে ওই ঘাটের বেঞ্চিতে বসেছিলাম, যখন সুশীল এলো, তখনই তো দিগন্তকে একটু দুর দিয়ে বটগাছের দিকে যেতে দেখেছিলামকিন্তু তারপর আর কই দেখতে পেলাম না ওকে।”

ওদের দুজনের কথাবার্তা শুনে সুশীল বলল, “তারপর ও বাড়ি চলে গিয়েছিল, সেই কারণে দেখতে পাসনি।”

বাড়ি চলে গিয়েছিল,কিন্তু কেন?” লাবন্য একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো কথাটা

আচ্ছা আমি এখন আসি হ্যাঁ, দেরি হয়ে যাচ্ছেপরে কথা হবে।” বলে সুশীল তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে আসে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনে লাবন্য শান্তনুকে বলেছে, “হঠাৎ করে এসে চলে গেল কেন? তুই কিছু জানতিস।”

সুশীল বাইক নিয়ে যখন স্কুলের গেটের কাছে আসে মঞ্চে তখন নাটক শুরু হয়েছেসুশীলের বাড়ি যাওয়ার পথে একটা জায়গায় বামদিকে মোড় নিয়ে প্রায় দেড় মাইল মতো পথ গেলে দিগন্তের বাড়ি পড়েবাড়ির কাছেই রয়েছে একটা বিশাল খেলার মাঠরাস্তার ধারে যেখানটায় মাঠ এসে মিশেছে রাস্তার সঙ্গে সেখানে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড বট গাছআর মাঠের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে শ্মশান

সুশীল তার বাইক নিয়ে যখন মাঠটার কাছে উপস্থিত হয় তখন সাড়ে সাতটা বেজেছেবটগাছটা অতিক্রম করতে করতে সুশীলের হঠাৎ নজর যায় ডান পাশে শ্মশানের দিকেদেখতে পায় প্রকাণ্ড এক আগুনের কুন্ড দাউ দাউ করে জ্বলছেমনে মনে ভাবতে থাকে, “কেই বা চলে গেল নিজের আপন জনদের ছেড়ে।”

সুশীল যখন প্রায় দিগন্তের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে তখন একটা অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ ওর কানে ভেসে আসতে লাগলোমহিলার কণ্ঠস্বরকে হতে পারে এই মহিলা, কথাটা ভাবা মাত্রই ওর মনে পড়ে গেল একটু আগে দেখা শ্মশানের সেই আগুনের কথাতৎক্ষণাৎ ওর মনের ভেতর যেন এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আশঙ্খা দানা বাঁধতে লাগলো। “তবে কি দিগন্তের…!” কথাটা ভাবা মাত্রই সুশীলের বুকের ভিতরটা ঢিপ করে উঠলো

কয়েক সেকন্ড পর সুশীল দিগন্তের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালোনিজের বাইকের তীব্র হেডলাইটের আলোয় দেখলো সামনে একখানি সদ্য ভেঙে যাওয়া বাইক দাঁড় করানো রয়েছেবাইকটা দেখা মাত্র ও চিনতে পারলো, দিগন্তের বাইককিন্তু এই ভাবে ভেঙে যাওয়ার কারন কি হতে পারে? দিগন্ত ওকে বলেছিল, স্কুলে আসার সময় বাইক বিকড়ে যাওয়ায় ওখানেই ফেলে এসেছিল বাইকটাকেতবে কি স্কুল থেকে দুপুরে তাড়াতাড়ি ফিরে বাইকটাকে ঠিক করে নিয়ে আসবার সময় কোনো দুর্ঘটনা, না না কি সব আবোল তাবোল ভাবছে সেকিন্তু বাইকটাকে এই অবস্থায় দেখার পর সুশীলের আশঙ্খাটা যেন এক ধাপ বেড়ে গেলতাই ও তাড়াতাড়ি নিজের বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে সামনের বাগান অতিক্রম করে দু-ধাপ উঠোন পেরিয়ে দরজার সামনে উপস্থিত হল দরজাটা ভেজানোই ছিল, হালকা চাপ দিতে খুলে গেলসুশীল দেখলো একটু দুরে মেঝের উপর দিগন্তের মা হাত পা ছড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেআরও তিন জন মেয়ে মানুষ একসঙ্গে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেকিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা বিফলে যাচ্ছেসুশীলকে দেখে কান্না যেন আরো বেড়ে গেলএক-পা দু-পা করে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সুশীলের চোখ গেল সামনের দেওয়ালের দিকেকিন্তু একি, এটা কি দেখছে ও, দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে দিগন্তের একখানি ছবি আর তার থেকে ঝুলছে রজনীগন্ধার মালাসুশীলের আশঙ্খার পারদ চড়লোবুকের ভেতরটা যেন আরও বেশি করে ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো

একটু সামনে বামদিকে একটা তক্তপোশের উপর কয়েকজন লোক বসেছিলসুশীল কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে  বসল তার উপরতারপর ওই তক্তপোসের উপর বসা একজনের কাছে সুশীল যা শুনলো তাতে ওর সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল এ কি শুনছে ও, দিগন্ত আর বেঁচে নেই এটা কি করে সম্ভব, একটু আগেও তো ওকে সুশীল আর ভাবতে পারে না ওর দু-চোখ ছলছল করে উঠতে থাকে বুকের ভেতর তোলপাড় করে জেগে ওঠা কান্নাটাকে শক্ত করে চেপে দেয়একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দেয়ালে টাঙ্গানো দিগন্তের ছবিটার দিকে

দিগন্তের মা তখনো পর্যন্ত একই ভাবে কেঁদে চলেছে। ছবি থেকে ভেজা চোখ দুখানি সরিয়ে সুশীল জিজ্ঞাসা করে, “কটার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল?”

তক্তপোশের এক কোণে দিগন্তের কাকা বসেছিল। দিগন্তের বাবা নেই। দিগন্তের যখন সাত বছর বয়স, দিগন্তের বাবা তাকে একলা করে চলে যায় তারপর থেকেই দিগন্তের কাকা দিগন্তকে নিজের ছেলের মতোই দেখে এসেছে।

সুশীলের ধীর কণ্ঠে বলা প্রশ্নের জবাবে বিহ্বল শোকার্ত সুরে তিনি বললেন, “বেলা প্রায় সাড়ে দশটার সময় একটা অচেনা নম্বরে কল আসে। বলে যে, একটা লরির সঙ্গে নাকি দিগন্তের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তারা তাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আমাদেরও তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি হসপিটালে গিয়ে পৌঁছাই গিয়ে শুনি যে দিগন্ত নাকি মাঝরাস্তাতেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কেন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না

এই সময়ে হঠাৎ দিগন্তের মায়ের কিছু কথা সুশীলের কানে ভেসে আসেনিয়ে গেল নিয়ে গেল, বাছার আমার বুকের বামদিকটা একেবারে ছ্যাঁদা করে নিয়ে গেল গো।বলে তীব্র কান্নায় ফেটে পড়ে।

সুশীল একটু অবাক হলো কথাটা শুনে ছ্যাঁদা করে নিয়ে গেল মানে?

এদিকে দিগন্তের কাকা বলছেন, “তারপর death certificate আর শব দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরি বাড়িতে এসে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়, তখন কেন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়েছিল দিগন্তকে।”

কেন নিয়ে গিয়েছিল?ধীর মোলায়েম সুরে সুশীল প্রশ্নটা করলো

অস্ত্রপ্রচার করে দিগন্তের হৃৎপিণ্ডটা ওরা বার করে নিয়েছিল।প্রায় কাঁদতে কাঁদতে কথাটা শেষ করলো দিগন্তের কাকা

কথাটা শুনে সুশীল চমকে উঠলো এখন ও বেশ বুঝতে পারছে দিগন্তের মা তখন কেন ওই কথা বলেছিল সুশীল দেখলো ওর সারা শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। কাঁপতে কাঁপতে বললো, “কিন্তু, কিন্তু এটা তো আইনত অপরাধ অনুমতি বিনা কোনো মৃত মানুষের শরীর থেকেপুরো কথাটা সুশীল শেষ করতে পারলো না দেখলো, দিগন্তের কাকা একটা ভাঁজ করা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে সুশীল দেখলো কাগজের একেবারে উপরের দিকে বড়ো বড়ো করে লিখা রয়েছে National Organ and Tissue Transplant Organisation (NOTTO), অর্থাৎ কেউ স্ব-ইচ্ছায় নিজের মৃত্যুর পর তার শরীরের কোনো অঙ্গ দান করতে চাইলে, এই রকম কাগজে আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এটা সেই কাগজ কাগজের নিচে ডানদিকে দিগন্তের একটা দস্তখত ও দেখতে পেল সুশীলএকটা তারিখও দেওয়া রয়েছে দস্তখতের সঙ্গে তারিখটা দেখে সুশীল খুব অবাক হলো, প্রায় এক বছর আগের দেওয়া একখানি তারিখগত এক বছরের মধ্যে কই দিগন্ত তো এ ব্যাপারে তাকে কিছু বলেনি।

সুশীল বললো, “আচ্ছা দিগন্ত আপনাদের এ সমন্ধে মানে এই রেজিস্ট্রেশনের সমন্ধে আগে কি কিছুই বলেনি?”

আসলে ব্যাপারটা জানবার পর আমিও ভীষণ অবাক হইসত্যি বলতে কি, দিগন্ত এ বিষয়ে বাড়ীর কাউকে কোনোদিন কিচ্ছু বলেনি আজকেই ওর পড়বার ঘর থেকে এটা খুজেঁ পাওয়ার পর পুরো ব্যাপারটা জানতে পারি।

সুশীলের মাথাতে এখন একটা একটা করে অসংখ্য প্রশ্নের মেঘ ঘনীভূত হতে শুরু করেছেদিগন্ত কি এ ব্যাপারে সত্যি কাউকে কিছু বলেনি? দিগন্তের কাকা বলছেন সাড়ে দশটা নাগাদ অ্যাকসিডেন্টে দিগন্ত মারা গিয়েছে। কিন্তু, সাড়ে এগাোটার সময় সে তো নিজের চোখের সামনে দিগন্তকে দেখেছে, তার সঙ্গে কথা বলেছে, এমনকি দুজনে একসাথে স্কুল মাঠেও গিয়েছে। কিন্তু সুশীল আর দিগন্তের কাকাকে এসব কিছু জানালো না। পাছে তাকে পাগল ভেবে বসে কিংবা এই শোকের মুহূর্তে ইয়ার্কি করছে ভেবে দু-চারটা গালি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়

সুশীলের আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগলোস্কুলের একটা ঘটনায়দিগন্তকে সামনে দেখতে পেয়ে রূপরেখা কেন ওভাবে মূর্ছা গিয়েছিল? তবে কি ও জানতো যে দিগন্ত আগেই মারা গিয়েছে? আর যদি জেনে থাকে, তবে কাউকে কিছু বলেনি কেন? নাকি ও গোপন রাখতে চেয়েছিল ব্যাপারটাকে? আর গোপন রাখতেও বা কেন চাইবে? কোনো বিশেষ কারণে কী?’

সুশীলের সন্দেহ হতে লাগলো, এটা কি সত্যি অ্যাকসিডেন্ট নাকি কারুর দ্বারা…? না না, আরও ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে ব্যাপারটা নিয়েসুশীল আর বসে থাকলো না। কিছুক্ষন দিগন্তের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বেরিয়ে এলো ওখান থেকে

বাইক নিয়ে সুশীল যখন রাস্তার ধারের বটগাছের নিচে এসে দাঁড়াল, চিতার আগুন তখনো সেই আগের মতোই দাউদাউ করে জ্বলছে সুশীল সবটা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলো, ‘দিগন্ত স্কুলে বলেছিল, রূপরেখার স্বামীর হার্টের অপারেশন আজকের মধ্যেই না করালে, তার স্বামীকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে নাকিন্তু অপারেশনের জন্য সুস্থ হার্টের সংকটএই অবস্থায় রূপরেখা আর কি করবে। টাকাপয়সার ওর অভাব নেই। কিন্তু এমন অবস্থায় নিজের চোখের সামনে স্বামীকে মরতে দেখা ছাড়া তো আর অন্য কোনো উপায় নেই, নাকি রয়েছে উপায়, সে কি অন্য কোনো উপায় ভাববে নিজের স্বামীকে বাঁচাতেঅন্য কোনো দ্বিতীয় উপায়।

দ্বিতীয় উপায়। কথাটা ভাবা মাত্র সুশীলের মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই ভাবে তো সে একবারও ভেবে দেখেনি। নিজের মনে মনে একটা সন্দেহের থিওরি খাড়া করতে থাকে সুশীল

রূপরেখা যদি কোনো ভাবে দিগন্তের NOTTO তে রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারটা জানতে পারে যদি জানতে পারে দিগন্তের মৃত্যুতে একটা তরতাজা হার্ট পাওয়া যেতে পারে, যেটা অন্যদিকে তার স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করবে তবে কি রূপরেখা নিজের স্বামীকে বাঁচাতে একটা শেষ চেষ্টা করবে না? আর এই শেষ চেষ্টাটা যে দিগন্তের বেঁচে না থাকা সেটা তো বেশ স্পষ্ট

সুশীলের চোখ লাল হয়ে উঠলো। ভীষণ, ভীষণ রাগ হতে লাগলো মেয়েটার উপর। নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু ছিল দিগন্ত। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে হয়তো দিগন্তের উপর রাগ হতো ওর, সময়ে না পৌঁছালে হয়তো বকাঝকা করতো, কিন্তু একটা অদৃশ্য ভালবাসার বন্ধন ছিল দুজনের মধ্যে সেই বন্ধন আজ এক-তরফা ভালবাসার পাপে চুরমার হয়ে গেছে

কি নিষ্ঠুর মন, নিজের আপন জনকে বাঁচাতে গিয়ে, যে তোকে এতো ভালোবাসলো তাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলি

সুশীল আর নিজেকে সামলাতে পারলো না ছলছলে চোখ থেকে এক ফোঁটা জল এসে পড়লো তার হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রিনটার উপর। বামদিকে শ্মশানে চিতার আগুন তখনো সেই আগের মতোই জাজ্বল্যমান। কত রাগ, কত অভিমান, কত বিরহ, কত না পাওয়ার বেদনা, কত স্বপ্ন সব কিছুই আজ আগুনের লেলিহান শিখাতে কোথায় হারিয়ে যাবে পড়ে থাকবে শুধু এক মুঠো ছাই, যার মধ্যে থাকবে না সেই হৃদয়ের স্পর্শ, যে হৃদয়ের ধুকপুকানি শুরু হয়েছে অন্য কোনো শরীরে

বন্ধু হারানোর শোকে সুশীল এতটাই মূহ্যমান হয়ে পড়েছিল কখন যে মোবাইলটা বেজে উঠেছে ও টেরই পায়নিচোখ গেল মোবাইলের স্ক্রিনে, দিনু। দিনু সুশীলের সঙ্গে হঠাৎ করে বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াদের মধ্যে একজন। পড়াশোনা বেশি একটা করেনি। বাপ ঠাকুরদাদার কয়েকটা গাড়ি রয়েছে সেগুলোই চালায়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সুশীলের

মোবাইলটা হাতেই ধরা ছিল, কলটা রিসিভ করে কানে তুলে নিলওদিক থেকেই প্রথমে কথাটা এল

আরে শুনেছিস কিছু খবর?

কী?”

একটা ভয়ানক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে চৌরঙ্গীর কাছে।

অ্যাকসিডেন্ট সবসময় ভয়ংকরই হয়।

কিন্তু এটা অন্যান্য অ্যাক্সিডেন্টের চেয়ে আলাদা

কিরকম?

তুই তো আসবি নাকি এখানে। নিজের চোখেই তো তাহলে দেখতে পাবি

কোথায় বললি জায়গাটা?

ওই তো, চৌরঙ্গী থেকে আড়াইশো মিটার উত্তরে যে টাটা মোটরস লিমিটেড টা রয়েছে তার ঠিক সামনেই

NH14

হ্যাঁ

 

বাইক নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সুশীলের সময় লাগলো পনেরো মিনিট গিয়ে দেখল, চারদিকে মানুষজনের বেশ ভিড় জমেছে রাস্তার একদিকে একটা অ্যাম্বুল্যান্স উল্টে হয়ে পড়ে রয়েছে উল্টো অ্যাম্বুল্যান্স আর মানুষদের ভিড়ে রাস্তা প্রায় পুরোপুরি ব্লক হওয়ায়  গাড়ি গুলোর যাতায়াতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে।

সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল দিনু সুশীলের সঙ্গে দেখা হতে দুজনে ভিড় ঠেলে ভেতরে গেল। একটা গোল ব্যারিকেট, আর তার চারপাশে সমস্ত লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলকেউ চুপচাপ ছিল না, কে আগে গিয়ে ছবি তুলতে আর ভিডিও করতে পারে এই নিয়ে যেন হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছিল

দিনু সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, “দেখেছিস তো কি অবস্থা অ্যাকসিডেন্টে গাড়ির ডাইভার আর দুজন নার্স ভয়ানক ভাবে আহত হলেও, বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু, এই দুজন পুরো স্পট ডেড

কিভাবে হলো অ্যাকসিডেন্ট টা? পেছন থেকে কি কোনো বড়ো গাড়ি এসে

ধুর! অ্যাম্বুলেন্সকে কে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে যাবে কিন্তু সবাই বলছে

কী বলছে?

বলছে গাড়িটা নাকি মাঝ রাস্তাতেই হঠাৎ করে উল্টে যায় আর অ্যাম্বুলেন্সের স্পিড তো কি রকম হয় জানিস, তাতেই এই অবস্থা

হঠাৎ করেই মাঝ রাস্তাতেবিড়বিড় করতে করতে সুশীল সামনের মৃত দেহ দুটির দিকে তাকায় একটি পুরুষ আর একটি নারী দেহ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে রাস্তার উপর মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত চাপ-চাপ রক্ত রাস্তার উপর কালো রঙের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। রক্তাক্ত মুখ গুলো অন্ধকারে ঠিক চেনা যাচ্ছে না

একজন পুলিশ অফিসার তার টর্চ জ্বেলে মৃতদেহ দুটিকে পর্যবেক্ষণ করছিল হঠাৎ টর্চের আলো নারী দেহের মুখের উপর গিয়ে পড়তে সুশীল চমকে দু-পা পেছনে সরে গেল। এই মুখ যে ও চেনে, আজকে স্কুলেও দেখেছে, রূপরেখা। তারপর সুশীল টর্চের আলোয় দেখলো, মৃতদেহের বুকের ঠিক বামদিকে একটা গর্ত। কিসের গর্ত ওটা! ঠিক যেন কেউ শাবল দিয়ে হাড় মাংস খুঁড়ে পাঁজর থেকে হৃৎপিণ্ডটাকে উপড়ে নিয়ে গেছে পুরুষটির বুকেও ওই একই রকম একটা গর্ত কিন্তু এই গর্তের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্ত মাখা কিছু ব্যান্ডেজের টুকরো। সুশীল বুঝতে পারলো, এ নিশ্চই রূপরেখার স্বামী। যার কথা দিগন্ত আজকে তাকে স্কুলে বলেছিলদেখে মনে হচ্ছে হার্টের অপারেশনের পর কোথাও যাচ্ছিল আর মাঝপথে এই অবস্থা

সুশীল জিজ্ঞাসা করতে দিনু বলল,অপারেশনের পর অন্য একটা হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছিল রোগীকে

অন্য হসপিটালে কেন?

সেটা আমি কি করে জানবো বল। কিন্তু বড্ড আফশোস হচ্ছে।

কেন তুই কি জানতিস নাকি এদেরকে?”

দিনু ফিসফিস করে বলল, “আরে, তোকে তো একটা কথা বলবো বলে আর বলা হয়নি বাইরের দিকে চল বলছি।

দিনু সুশীলের হাত ধরে ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াতে সুশীল জিজ্ঞাসা করলো, “কী কথা?”

কাল বিকালে এই ম্যাডাম, কি যেন নাম.. হ্যাঁ, রূপরেখা। যেখানটায় আমাদের লরি গুলো সার করে দাঁড় করানো থাকে, সেখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলে - ‘তোমার জন্য একটা কাজ রয়েছে, যদি করতে পারো তাহলে অনেক টাকা পাবে

আমি কৌতূহল বশত জিজ্ঞাসা করি - ‘কি কাজ?

আগামীকাল চৌরঙ্গী হয়ে একটা ছেলে বাইক নিয়ে যাবে এই যে ছবি দেখছো… ’বলে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠা একটা ছবি আমার চোখের সামনে তুলে ধরে

‘…এই  ছেলেটাকে তোমার লরির তলায় চাপা দিয়ে

না না আমি ওসব পারবো না।

এক লাখ টাকা দেবো কাজটা করে দিতে পারলে

আমি রাজি হচ্ছি না দেখে এক লাখ দু লাখ করে টাকার লোভ দেখতে থাকে শেষে বলে, পাঁচ লাখ টাকা দেবো, ভেবে দেখো।

আমি আর লোভ সামলাতে না পেরে রাজি হয়ে যাই

কিন্তু এখন তো মরে গেল, বেঁচে থাকলে হয়তো আরও কাজ পাওয়া যেত হাতে বেশ মালকড়ি আসতো

এই ছেলেটাই কিনা দেখ তো?বলে সুশীল মোবাইলের গ্যালারি থেকে দিগন্তের একখানি ছবি দিনুর চোখের সামনে তুলে ধরলো

দিনু উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এইটা এইটা!

সুশীলের এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগলো মোবাইলটাকে পকেটে রাখতে তারপর তার দশটা আঙুল দুটো বদ্ধ মুষ্টি হয়ে খামচে ধরলো দিনুর জামার কলারটাকে হ্যাঁচকা টানে একহাত দূরে থাকা দিনুর মুণ্ডটাকে নিজের চোখের সামনে নিয়ে এলো তারপর চোখে চোখ রেখে দাঁত কামড়ে বলল, “তবে তুই ওকে মেরেছিস!দিনু নিজেকে সুশীলের বজ্র মুষ্টি থেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো সুশীলের একবার মনে হলো দিনুকে মাথার ওপরে তুলে রাস্তার উপর সজোরে একটা আছাড় দেয়। কিন্তু ওদের দাপাদাপি দেখতে পেয়ে একজন পুলিশ ওদের দিকে এগিয়ে আসতে সুশীল দিনুর কলারটা ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোকে আমি পরে দেখে নেব!কাথাটা শেষ করে সুশীল সঙ্গে সঙ্গে বাইক নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল

 

সুশীলের কাছে সবটা এখন জলের মতোই পরিষ্কার ওর তৈরি সন্দেহের থিওরি এখন আর সন্দেহ নেই, সত্যি হয়েছে। এ জগতে ভালোবাসা না পেয়ে দিগন্ত নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে গেছে অন্য এক জগতে। যে জগতের হদিস সুশীল না জানলেও দিগন্ত নিশ্চই এতক্ষনে জেনে ফেলেছে। কিন্তু সুশীলের দুঃখ একটাই, দিগন্ত তাকে পুরো একলা করে চলে গেল এখন আর ফোন করে কাউকে গালি দেওয়ার লোক নেই। জামার বোতাম খুলে স্যান্ডো গেঞ্জি বার করে জামা উড়িয়ে কোন এক বিকেলে দূর দূরান্তে বেরিয়ে পড়বার সঙ্গি আর নেই। সুশীলের আজ বড়ই মনে পড়ছে স্কুলের সেই হারানো স্মৃতি গুলো।

সেই রাতে সুশীলের আর ঘুম এলো না। অনেক চেষ্টা করলো ঘুমানোর। কিন্তু সারা রাত শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি।

 

দুদিন পর একদিন সকালে সুশীল খবর পেল, দিনু নাকি অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে ঠিক সেই জায়গায় যেখানটায় অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল রূপরেখা আর তার স্বামীঠিক সেই ভাবে যে ভাবে রূপরেখা আর তার স্বামী মারা গিয়েছিল ঠিক সেই রকমই বীভৎসতা, বুকের বাম দিকে একটা গর্ত, আর সেখান থেকে হৃদপিণ্ডটাকে কেউ যেন ছিঁড়ে বার করে নিয়েছেকিন্তু পার্থক্য একটাই, সেদিন রাতের ঘটনায় দুজনের দুটো হৃদপিণ্ড মৃতদেহের আশেপাশে কোথাও দেখা যায়নি আর দিনুর অ্যাক্সিডেন্টে তার হৃদপিণ্ডটা তার থেকে খানিক দূরেই পড়েছিল।

সেদিন রাতে সুশীল দিগন্তের দেওয়া একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছিল হঠাৎ একটা পাতা উল্টাতে সুশীলের চোখে পড়লো একটা  ছোট্ট সাদা কাগজ কাগজটার উল্টো দিকে কিছু লিখা থাকতে পারে এই ভেবে সুশীল কৌতুহলী হয়ে সেটা হাতে তুলে নিল। উল্টানো কাগজটাকে সোজা করে সুশীল পরিষ্কার আলোতে দেখল দিগন্তের হাতের লেখা সহ একটা কাগজ। কাগজের মাঝখানে লাল কালিতে আঁকা রয়েছে একটা love sign. আর তার ঠিক মাঝখানে কালো কালিতে লেখা রয়েছে শেষ দেখা’