আজ শুক্র বার, ডঃ বি আর আম্বেদকরের জন্মদিন সঙ্গে চড়ক, কাল শনি বার বাংলা নববর্ষ, পরদিন রবিবার এমনিতেই ছুটি। এতগুলো দিন ছুটি পেয়ে স্কুল কলেজের ছেলেরা নিশ্চই খুব খুশি। পড়ার সূত্রে যারা বাড়ির বাইরে অর্থাৎ হাজার কিমি না হোক আপাতত একশো কিমির মধ্যে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই যে গতকাল বৃহস্পতি বার পাকতাড়ি গুটিয়ে পালিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যারা বাকি ছিল তারা আজ অর্থাৎ শুক্রবার সকালে যাচ্ছে। আর যারা যাবে না তারা পুজোর ছুটির অপেক্ষায় আছে।
দু মিনিট বাকি। ট্রেন স্টেশন ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। দুটো মেয়ে ছয় নম্বর কামরাতে উঠল। একটা সিট পুরো ফাঁকা দেখে ওরা জানালাধার ঘেঁষে বসল। সামনের সিটে শুধু একটা ছেলে বসে রয়েছে। বসবার সময় ছেলেটার সঙ্গে ওদের চোখাচোখি হলো। সামনে বসা মেয়েটা নেহাতই খারাপ নয় দেখতে। একপলকের নজরে ঠিক করে দেখা হয়নি। ট্রেন ছাড়লে আড় চোখে দেখে নেওয়া যাবে। হাতে ধরা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল ছেলেটা, নাম তন্ময়।
ওদিকে জানালা ধারে বসা মেয়েটা, যার নাম অন্তরা সে ভাবছিল, “ছেলেটা কি কলেজে পড়ে, ভারী কিউট দেখতে”। যাত্রার মাঝে যদি ছেলেটা ওর সঙ্গে কথা বলে তবে সেও অনেক কথা বলবে। এমনিতেই সে বকবক করতে খুব পছন্দ করে।
পাশের মেয়েটা যার নাম শিউলি, সে ভাবল, ওদের দুজনের মধ্যে অন্তরাকে দেখতে ভালো। ছেলেটা নিশ্চই অন্তরার দিকেই বেশি অ্যাটেনশান দেবে, যা প্রতিটা ছেলের স্বাভাবিক স্বভাব। তাই সে বেশি কিছু ভাবল না। শুধু ভাবল, “এমন একখানি ছেলে যদি তার বয়ফ্রেন্ড হতো তবে বেশ হতো।”
ট্রেন ছাড়ার কিছু পরে এক দমকা হাওয়া এসে তন্ময়ের চোখে মুখে লাগাতে, অন্তিম বসন্তের গরম থেকে নিস্তার পেয়ে ঠান্ডা ভাব অনুভব করলো। এখন সকাল সাতটা। বাইরে তাকিয়ে দেখল, সূর্যদেব ইতিমধ্যেই এ ধরাধামে তাঁর জ্বালানো পোড়ানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আজ পারদে ৪২° সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠবে। কাল থেকে গ্রীষ্ম শুরু, সূর্যদেব আরো হাসবেন। আবহাওয়ার খবরে বলেছে, এ সপ্তাহে ৪৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে।
শিউলি ও অন্তরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। দুজনে একই মেসে থাকে তবে দুজনের সাবজেক্ট আলাদা। শিউলির কাল কলেজ থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল, না হলে কালকেই ওরা বাড়ি চলে আসতো। ট্রেনের শব্দ ও হাওয়ার বেগের মাঝে তন্ময়ের কানে সামনে দুজনের কথাবার্তা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। শিউলি একটা কথা বললে অন্তরা দশটা কথা বলে। মাঝে মধ্যে নিজেদের কানে কানে কি যেন বলে। ওকে নিয়ে কি কিছু বলাবলি করছে ওরা, তন্ময় ভাবে।
শিউলির কানের কাছে গিয়ে অন্তরা ফিসফিস করে বলল, “তখন থেকে মোবাইলে কি করছে বল দেখিনি।”
শিউলিও একইরকম ফিসফিস করে বলল, “বোধ হয় ওর গার্লফ্রেন্ডের ছবি দেখছে।”
অন্তরা সোজা হয়ে বসে স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আমার দাদা-ভাইয়েরও ছিল, আমি কিন্তু ধরে ফেলেছিলাম।”
“কি ছিল ?” শিউলি বলল।
অন্তরা আবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড।”
“ও আচ্ছা।”
অন্তরা আবার সোজা হয়ে বসে বলল, “দাদাভাইকে বলছিলাম, দাদাভাই ও রান্না করতে পারে। দাদাভাই বলল, তুই পারিস রান্না করতে ? পাশে মাসি ছিল, বলল, হ্যাঁ ও তো খুব ভালো রান্না করতে পারে। কয়েকদিন আগেই রান্না করেছিল তবে সেদিন আমরা সবাই না খেয়ে ছিলাম।”
কথাটা শুনে তন্ময় ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর হঠাৎ দুটো মেয়ে কথা বন্ধ করে ওর দিকে তাকাতেই তন্ময় তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেয়ে দুটো আগের মতো কথা চালিয়ে গেল।
“এটা অনেকদিন আগের ঘটনা। এখন আমি অনেকটাই রান্না শিখে গেছি।”
“হ্যাঁ জানি, আর বলতে হবে না। তুই চুপ কর।”
“তোর বিশ্বাস হচ্ছে না, সেদিন যে রান্না করেছিলাম, তুই তো খেলি। তবুও…।”
ট্রেন লম্বা একটা ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছে। নিচে নদীর দিকে তন্ময় তাকিয়েছিল। নদীর পরিষ্কার জল বাতাসের তাড়নায় ছোটো ছোটো বিশৃঙ্খল ঢেউ খেলে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের উপর সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে চকচকে আলোর রোশনাই প্রতিফলিত করছে।
তন্ময় মোবাইলে সময় দেখল, কত সময় হয়েছে, কত সময় লাগবে পৌঁছাতে। একা একা বিরক্ত হচ্ছে। হাতে মোবাইল আছে কিন্তু সারাক্ষণ কি আর মোবাইল ঘাঁটতে ভালো লাগে। এদিকে প্রথম থেকেই ইচ্ছে হচ্ছিল সামনে যে মেয়েটা বসেছে তার সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। কথা বলতে গেলে যদি এড়িয়ে যায় কিংবা দু চার কথা শুনিয়ে দেয় এই ভয়ে আর এগোতে পারছে না। উফ্ কবে যে স্মার্ট হবে !
মেয়ে দুটো সেই আগের মতই গল্প করছিল। এবারে নতুন এক প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে, পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে। সামনের মেয়েটা বান্ধবীকে নিজের পোশাকের দিকে দেখিয়ে বলছে, “এক মাস হলো এটা কিনেছি। আমার তো প্রতি মাসে অন্তত একটা করে পোশাক কিনতেই হবে।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। এবার তুই চুপ কর।” একটু বিরক্ত হয়ে শিউলি বলল।
অন্তরা কিন্তু নাছোড় বান্দা, বলল, “এই শোন না। শোন বলছি একটা কথা।”
“না আমি আর কিছু শুনবো না। তুই চুপ করে বস, খালি বকে।” বলে শিউলি উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
অন্তরা আলতো করে শিউলির মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “এইটা শুধু আর কিছু না। কি আছে বলতো একটা মেয়ের জীবনে। বিয়ের আগে পড়াশোনা করতে করতে সময় কেটে যায়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই, একটু মোটামুটি দেখতে ভালো হলে বাড়িতে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর সেই বাঁধা ধরা এক ঘেঁয়ে জীবন। জীবনে একটুও অ্যাডভেঞ্চার নেই। ধুর ভালো লাগে না।”
শিউলি হাসছিল। অন্তরা একবার তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে ভাবল, কি ছেলেরে বাবা, মুখ থেকে একটা কথাও বেরালো না। মুখচোরা, নাকি কথাই বলতে পারে না, বোবা। বোবাই হবে বোধহয়। যাক গে ভগবান ওর মঙ্গল করুক।
ওদের
স্টেশন চলে আসতে দুজনে উঠে পড়ল। তন্ময়ের নজর গেল মেয়েটার দিকে। শেষ বারের মতো দুজনের চোখাচোখি হলো। তন্ময় কিছু বলবে ভেবেও বলতে পারলো না। যাত্রীরা
ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। একটু পর ট্রেন
স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।