Image collected from internet |
মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। রেজাল্ট বোর্ডের সামনে ভিড় ঠেলে রেজাল্ট দেখার যে কি ঝক্কি সেটা আকুল খুব ভালো করেই জানে। সামনের দিকে রোল নম্বর হলে স্যার কিংবা অন্য কোনো ছেলেদের কাছ থেকে রেজাল্ট জানতে পারা যেত। কিন্তু সে অ্যাভারেজ স্টুডেন্ট, নাম খুঁজে বের করতে হবে। গত বার ২৯শে নাম ছিল। এবারে কত তে আছে কে জানে।
আকুল একে ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। উপর থেকে দেখা শুরু করলো। বুকটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে। কত তে নাম থাকতে পারে ? ২৮,২৫ নাকি ৩৫। আকুলের চোখ ৩৩ শে এসে স্থির হলো। রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।
আকুল আর থাকলো না বেশিক্ষণ। সাইকেল নিয়ে তখুনি বাড়ি ফিরবে বলে বেরিয়ে এলো। স্কুলের গেট দিয়ে যখন বেরোচ্ছে আকুল মনে মনে ভাবছে, “বাড়ি ফিরেই ফাইনালের জন্য আরো ভালো করে প্রস্তুতি শুরু করে দিতে হবে। একটুকুও ঢিলেমি নয়। ৮৫% এর উপর নম্বর তুলে ২০ এর মধ্যে নাম আনতেই হবে।”
স্কুল থেকে আধ মাইল দূরে পাঁচু ভট্টর মিষ্টির দোকানের কাছ অবদি এসেও আকুল ভেবেই চলেছে, “ইংলিশটা তে একটু দুর্বল রয়েছে। গ্রামার আর প্যারাগ্রাফ গুলোর উপর একটু বেশি জোর দিতে হবে। ভূগোল আর জীবন বিজ্ঞানের ছবি গুলো ভালো করে আঁকতে হবে। ইতিহাসের সাল তারিখ গুলো...।”
“আকুল।”
“...ভুলে যাই। এই জন্য বোধ হয় ইতিহাসে কম নম্বর এসছে।”
“আকুল।”
পেছন থেকে কেউ ডাকছে ভেবে আকুল সাইকেল থামিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। দেখল সুরভী হাত নেড়ে কি যেন বলতে বলতে তার দিকে আসছে। সুরভী, আকুলের দিদির বান্ধবীর বোন। সেই দিক দিয়েই ওদের মধ্যে চেনা জানা। আর অন্য দিকে দিয়ে বলতে গেলে সুরভী আকুলের প্রথম ক্রাশ। অবশ্য এই কথাটা আকুল এখনো পর্যন্ত কাউকে ভ্রুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি। নিজের মনের কোনো এক গোপন কুটুরিতে লুকিয়ে রেখেছে। শুধু সে একাই জানে, সুরভীকে তার কতটা ভালো লাগে।
কাছে আসতে সুরভী বলল, “এই আকুল, তোকে ডাকছি কখন থেকে শুনতে পাসনি নাকি ?”
“না আসলে আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। বল কি বলছিলি।”
“রেজাল্ট দেখে ফিরছিস মনে হচ্ছে। কেমন হলো বল।”
“ধুর ফালতু, খারাপ, ভালো হয়নি।”
“ও… টেস্টের রেজাল্ট, খারাপ হলেও কোনো এসে যায় না। ফাইনালে রেজাল্ট ভালো হলেই হলো।”
“হুম্ সেই কথাই ভাবছিলাম, আরও ভালো করে প্রিপারেশন নিতে হবে। আচ্ছা তোদের গার্ল স্কুলের রেজাল্ট কবে বেরোবে ?”
“পরশু।”
“ও তাই।”
আকুল খুশিই হলো। গার্লস স্কুলে রেজাল্ট বেরোলে ওদের বয়েজ স্কুলের সব ছেলেরাই বোধ হয় খুশিই হয়। কারণ বয়েজ স্কুলের প্রায় প্রতিটা ছেলের হয় ক্রাশ নয় প্রেমিকা ওই গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করে। সেখানে আগ্রহ টা যে একশো শতাংশ থাকবে তা নিয়ে কোনো অনিশ্চিয়তা নেই।
মিষ্টি দোকানের পাশের মুদি দোকান থেকে গোটা দশেক শ্যাম্পুর প্যাকেট নিয়ে সুরভী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখন আসি বুঝলি। খুব রোদ উঠেছে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যা যা না হলে কালো হয়ে যাবি। হা হা হা।”
“ধুর, যা ঘর যা।”
দুজনের যাত্রা পরস্পর বিপরীত মুখি। কিছুটা দুর গিয়ে আকুল একবার পেছন ফিরে তাকাল। দেখল সুরভী অনেকটা দূরে চলে গেছে। নিশ্চই বুড়ো আম গাছটার তলায় এতক্ষনে পৌঁছে গেছে। এরপর ছোটো একটা পুল পেরিয়ে, ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে পুব দিকে বাঁক নিলেই সুরভীদের দোতলা পাকা বাড়ি। পেছন দিকে তাকিয়ে থেকে আকুলও বাঁক নিল। কিন্তু ভুল বশত পশ্চিমে না বেঁকে সুরভীর দেখা দেখি পুব দিকে সাইকেলের হান্ডেলটা বাঁকিয়ে দিল। আর গিয়ে পড়ল পাহাড় করে রাখা নোংরা স্তুপের উপর।
কয়েক মাস পর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরাল। আকুল ৮৬% নম্বর পেলেও স্কুলের প্রথম ২০জনের মধ্যে জায়গা করতে পারলো না। তার নাম বেরাল বাইশে। কিন্তু আকুল তাতে এতটাও দুঃখী নয়। মনের মতো নম্বর পেয়েছে আর কি চাই। ওদিকে গার্লস স্কুলে খবর নিয়ে আকুল জানতে পারলো সুরভীর স্কুলের মধ্যে ১৩ তে নাম নাম এসেছে। তার মানে ভালো রেজাল্ট হয়েছে।
একাদশ শ্রেণীতে দুজনে যে যার নিজের নিজের স্কুলে ভর্তি হলো। আকুল কিন্তু মনে মনে ভাবছিল, সুরভী যদি অন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হয় তবে সেও গিয়ে ওখানে ভর্তি হবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। আকুল একটু নিরাশ হলো, কি আর করা যাবে। কিন্তু, একই স্কুলে না হোক একই টিউশানে তো থাকতেই পারে। আপাতত যদি একই টিউশনে দুজনে ভর্তি হয় তবে সামনা সামনি দেখা সাক্ষাতের কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেটাও হলো না। দুজনের আলাদা আলাদা টিউশন। দেখা পাওয়ার ভীষণ সমস্যা। তবে আকুল একেবারেই দমে গেল না। কারণ, বেশি কথা বলা হোক না হোক, আগের মতো মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতেই থাকবে। কিন্তু মাঝে মধ্যে না হয়ে একটু বেশিই হলে ভালো হতো। অল্পতে মন ভরে না।
একদিন বিকেলের ঘটনা। রাস্তার পাশে বয়েজ স্কুলের মাঠে প্রতিদিনের মতো সবাই ক্রিকেট খেলার তোড়জোড় শুরু হচ্ছে। আর কয়েকজন এলে দল ভাগ করে খেলা শুরু হবে। আকুলও এসেছে মাঠে। ক্রিকেট ওর প্রিয় খেলা। অল রাউন্ডার প্লেয়ার সে। তাই ক্রিকেট টা সে মিস করে না।
দল ভাগ হয়নি তাই মাঠে সবাই বল নিয়ে লুফোলুফি করছিল। ঠিক সেই সময় আকুলের নজর গেল পাশের রাস্তার দিকে। মোটা তার দিয়ে ঘেরা জালের ভেতর দিয়ে দেখলে রাস্তায় কে যাচ্ছে না যাচ্ছে ঠিক চেনা যায় না। কিন্তু আকুল ঠিক চিনেছে সাইকেল আরোহীনিকে। তৎক্ষণাৎ আকুল হাতে ধরা বলটাকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে মাঠের একপাশে রাখা সাইকেলটার দিকে দৌড়াতে থাকল। ওকে পালাতে দেখে ঋজু নামের এক বন্ধু বলে উঠল, “কি রে তুই যাচ্ছিস কোথায় ? দল ভাগ হবে এখুনি।
দূরে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকিয়ে আকুল বলল, “ডান হাতে চোট লেগেছিল কাল। প্রচুর ব্যাথা, আজকে আর খেলতে পারবো না রে। চোট সারলে আবার আসবো।”
“অদ্ভুত ব্যাপার, এতক্ষন বল ছুড়লো কিছুই হলো না। তারপর হঠাৎ ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।” ঋজু কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু একবার মাথা কামড়ে লাইনে দাড়ালো।
বাজার পেরিয়ে তিন কিমি দূরে সুরভীর ইংলিশ টিউশান। বাজারে ঢোকার আগেই আকুল দুশো মিটার পথ পেরিয়ে সুরভীকে ধরে ফেলল। হঠাৎ আকুল কে তার পাশে সাইকেল চালাতে দেখে সুরভী বলল, “কি রে তুই কোথায় যাবি ?”
“তেমন কোথাও না, খেলতে যাচ্ছি।”
“পেছনে খেলার মাঠ ফেলে এসে কোথায় খেলতে যাওয়া হচ্ছে শুনি।” সুরভী হেসে বলল।
“আরে ধুর ওখানে কি খেলা হয় নাকি। বেকার, ফালতু শুধু আড্ডা ছাড়া আর কিছুই হয় না। সেই জন্য একটু দূরে বট তলার মাঠে যাচ্ছি, যাতে ঠিক-ঠাক একটু শরীরচর্চা টা হয়।”
সুরভী অবাক হয়ে বলল, “সে তো অনেক দূর, বড়ো রাস্তা পেরিয়ে তা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। তুই এতদূর যাবি ?”
আকুল মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ সে কোনো ব্যাপার নয়।”
“আচ্ছা।”
“তারপর তুই কোথায় যাচ্ছিস ?” এমন ভাবে আকুল প্রশ্নটা করল যেন সে ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না।
“আমি তো ইংলিশ টিউশন যাচ্ছি।”
কথা বলতে বলতে ওরা দুজন বাজার পেরিয়ে এল। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর আকুল দেখল সামনে বিপদ। খানিক দূরে ওর এক স্কুলের বন্ধু তাদের দিকে আসছে। নিশ্চই স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে। একসঙ্গে দুজনকে দেখলে বাকিরাও ওর মারফত নিশ্চই জানতে পারবে। তারপর মিথ্যে চোটের বাহানা আর সুরভীর সঙ্গে পাশাপাশি কথা বলতে বলতে যাওয়া, দুইয়ে দুইয়ে চার করে সব বুঝে যাবে। কথা রটতে রটতে প্রথমে পুরো স্কুল তারপর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাবে। তখন এক বিশ্রী কেলেঙ্কারি হবে। তারচেয়ে বুদ্ধি করে সামলাতে হবে ব্যাপারটা।
সব কিছু ভেবে নিয়ে আকুল সুরভীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিয়ে বলল, “আচ্ছা সুরভী তুই এখন টিউশনে যা, আমি একটু এই দোকানে ঢুকবো। কনুইয়ের কাছে কেটে গিয়েছিল তাই একটা ব্যান্ডেড কিনতে হবে।”
সুরভী চলে গেল। একটু পর আগন্তুক বন্ধু নিলয়ের সঙ্গে আকুলের সামনা সামনি দেখা হলো। আকুলকে দেখতেই নিলয় বলল, “মাঠে না গিয়ে এখানে কি করছিস তুই ? খেলবি না নাকি আজকে ?”
“না, কনুইতে চোট তাই খেলবো না।”
নিলয় আর কিছু না বলে চলে গেল। নিলয়কে চলে যেতে দেখে আকুল সঙ্গে সঙ্গে জোর স্পিডে সাইকেল ছুটিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার সুরভীকে ধরে ফেলল।
এই ভাবেই এক সপ্তাহ কেটে গেল। আকুল প্রতিদিন খেলতে যাওয়ার বাহানায় সুরভীর সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে। সে অনেক কথা, জানতে চেষ্টা করে সুরভী তাকে পছন্দ করে কিনা। কিংবা পছন্দ করলেও কতটা পছন্দ করে। কিন্তু আকুল কোনো কিছুর তল পায় না।
এদিকে আকুলের বন্ধুরা খেলার মাঠে এসে প্রতিদিন ভাবে, ও ব্যাটা খেলতে কেন আসে না। এক সপ্তাহ কেটে গেল এখনো চোট সারলো না। নাকি অন্য কোনো কারণ রয়েছে না আসার।
নিলয় বলে, “আরে ওকে তো আমি অনেক বার দেখেছি বাজার পেরিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে যেতে। জিজ্ঞাসা করলে বলে, এটা আনতে যাচ্ছি, ওটা আনতে যাচ্ছি। খেলতে আসিস না কেন বললে বলে, হ্যাঁ যাবো যাবো।”
“কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের থেকে, ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরতে হবে বুঝলি।” ঋজু বলে।
অন্য আর একজন বলে, “তবে কালকেই চল না, দেখি কোথায় যায় ও প্রতিদিন।”
ঋজু একটু ভেবে নিয়ে বলে, “ওকে ডান, কাল বিকেলে ওর বাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে থাকবো। ও বাড়ি থেকে বেরোলেই ওর পিছু নেবো। কিন্তু বেশি জন নয়। আমি তুই আর নিলয়। বাকিরা মাঠেই থাকবে।”
কথা মতো পরদিন আকুল বাড়ি থেকে বেরোতেই তিন জন আকুলের পিছু নিল। আজকে সুরভীর টিউশন ছুটি ছিল, তাই আকুল বড়ো রাস্তার দিকে না গিয়ে সরাসরি স্কুল মাঠের দিকে বেঁকে গেল। কিছুক্ষণ পর ওর পিছু পিছু বাকি তিনজনও নিরাশ হয়ে স্কুল মাঠে হাজির হলো। ব্যার্থ অভিসার। আবারও দ্বিতীয়বার অভিসারে বেরাতে হবে আগামীকাল।
পরদিন তিন জনের অভিসার সফল হলো। আকুলের প্রতিটা পদক্ষেপ ওরা নজরে রাখলো, কিন্তু ভ্রুণাক্ষরেও আকুলকে জানতে দিল না।
পরের দিন স্কুলে, অংক স্যারের ক্লাসে মন দিয়ে আকুল স্যারের পড়া শুনছিল। সেই সময় ঋজু পেছন থেকে ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সুরভীকে কিন্তু বিশাল দেখতে ভাই।”
আকুল চমকে উঠলো। পেছনে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে গলা নামিয়ে বলল, “সু সু সুরভী, কে কে সুরভী।”
এবার নিলয় বলল, “উম, কি ভাবছিলি ডুবে ডুবে জল খাবি আর আমরা কিছুই জানতে পারবো না। হুঁ হুঁ সব জেনে গেছি।”
আকুল মনে মনে ভাবলো, সর্বনাশ এরা যদি সবাইকে এই সব কথা বলে বেড়ায় তবে তো সমস্যা। তাই পেছন ঘুরে মিনতির সুরে বলল, “এই প্লিজ, তোরা এই সব কথা কাউকে বলিস না।”
ঠিক এই সময় অংক স্যার আকুলকে দেখে ফেলল। অংক স্যার নিজের ক্লাসে ডিস্টার্ব একেবারেই বরদাস্ত করেন না। রাগী গলায় বলে উঠলেন, “বেয়াদব কোথাকার, আমি বোর্ডে অংক করাচ্ছি আর তুই পেছন ঘুরে গল্প করছিস।”
“না স্যার গল্প করিনি। একটা ডাউট ছিল সেটাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।” আকুল শুকনো মুখ করে বলল।
স্যার আরও রেগে বললেন, “ডাউট ছিল তো আমায় জিজ্ঞাসা করতিস, পেছনে ঘুরবি কেন ?
“সরি স্যার আর হবে না।” বলে মাথা নিচু করলো।
“ওর পেছনের জন দাঁড়া দেখি।”
ঋজু ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আমি তো বোর্ডের দিকে তাকিয়ে লিখছিলাম।
“আচ্ছা বস।”
স্কুল ছুটির পর আকুল কে রেগে একা একা চলে যেতে দেখে, ঋজু ওর দিকে দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে বলল, “সরি ইয়ার, বাট কাউকে বলিনি। তুই নিলয়কে জিজ্ঞাসা করতে পারিস।”
“ছাড় তো।”
“হ্যাঁ রে ও ঠিকই বলছে, কাউকে বলিনি। আর তুই ভাবলিও বা কি করে কাউকে বলবো।” নিলয় বলল।
সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে আকুলের কাছে না জানা সমস্ত কথা দুজনে শুনলো। যখন ওরা গার্লস স্কুলের সামনে এলো, নিলয় ইয়ার্কি করে বলল, “যাবি নাকি ভেতরে, হা হা হা।”
“ধুর, মাথা খারাপ নাকি।” আকুল বলল।
“আচ্ছা আকুল তোর কি মনে হয়, ও তোকে ভালোবাসে ?” ঋজু প্রশ্নটা করলো।
“ঠিক বুঝতে পারছি না। মেয়েদের মন ভাই, বোঝা বড়ো দায়।”
নিলয় বলল, “তুই প্রপোজ করে দেখ না, কি বলে।”
“এত তাড়াতাড়ি, না না। ভাবছি একটু সময় নিয়ে বলল।”
“হ্যাঁ একদম, আগে বোঝার চেষ্টা কর ও তোকে ভালোবাসে কিনা।” ঋজু বলল।
নিলয় বলল, “হ্যাঁ ততদিনে অন্য কেউ এসে নিয়ে পালিয়ে যাক।”
“হ্যাঁ এটাও ঠিক।” ঋজু বলল।
“সেই জন্যই ভাবছি সামনের সরস্বতী পুজোতে বলবো।”
ঋজু আর
নিলয় এক সঙ্গে বলে উঠল, “দারুন আইডিয়া।”
ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার ৩৮দিন আগে সরস্বতী পুজো পড়ল। পুজোর সময় গার্লস কিংবা বয়েজ উভয় স্কুলে অবাধে প্রবেশ করা যায়। তাই সব ছেলে মেয়ে এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। নতুন নতুন প্রেমের উদঘাটন, ব্রেকআপ, রোমান্স আরও কত কিছু যে ঘটে এই সময় তার কোনো হিসেব থাকে না।
পুষ্পাঞ্জলি শুরু হবে ১১টায়। তাই তেমন কেউ একটা এখনও আসেনি। কিন্তু আকুল সেই সকাল ৮টা থেকে এসে বসে রয়েছে। কাল সারারাত ভেবেছে, আজকে ও বলবেই বলবে। আজ থেকে হয়তো ওদের দুজনের সম্পর্কটা আরো গাঢ় ও কাছের হবে। আকুল মনে মনে এসব ভেবে একটু লজ্জা পেল।
আকুলের বাড়ির পথে আসার সময় ঋজু ও নিলয় যখন শুনলো, আকুল আটটার আগেই বেরিয়েছে তখন দুজনে মুচকি মুচকি হাসলো। কিন্তু স্কুলে এসে আকুলকে কোথাও দেখতে পেল না। এমনকি পুষ্পাঞ্জলির পরও আকুলের টিকিটারও হদিস পাওয়া গেল না কোথাও। দুজনে মিলে হন্যে হয়ে গার্লস স্কুল, বয়েজ স্কুল, এখানে, ওখানে চারদিকে খুঁজেও আকুলকে কোথাও পেল না। তারপর দুজনে একসময় ভেবেই নিল যে, সুরভী আর আকুল বোধ হয় কোথাও নির্জনে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
দুজনে মনে মনে আকুলকে সাবাশি দিতে দিতে নিজেদের স্কুল মাঠের দিকে গেল। মাঠের যত্রতত্র ছেলে মেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে কিংবা গাছের ছায়াতে বসে গল্প করছে। ওরা দুজনে আম গাছের তলায় ফাঁকা ব্রেঞ্চে বসল। নিলয় একটা শুকনো সরু আমের ডাল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে কাটতে হেসে বলল, “আমাদের আসার আগেই ব্যাটা সব কাজ সেরে ফেলেছে, হা হা হা। আচ্ছা কোথায় যেতে পারে বলতো ?
“স্কুল মাঠে।”
“অ্যাঁ, মাঠে ? কোন মাঠে ?”
“এই মাঠে।” বলে ঋজু সামনের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।
“এই মাঠে,কোথায় ?”
নিলয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ঋজু দ্রুত বেগে মাঠের মাঝখান দিয়ে সোজা হাঁটা লাগালো। ঋজু আচমকা বেঞ্চ থেকে উঠে এত দ্রুততার সঙ্গে কোথায় কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছে নিলয় ঠিক বুঝতে পারলো না। শুধু ঋজুর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে সামনে তাকিয়ে দেখল, দূরে গাছের ছায়া গুলোতে ছেলে মেয়েরা বসে গল্প করছে।
মাঠ পেরিয়ে এসে দুজনে গাছের ছায়াতে প্রবেশ করল। সামনের বেঞ্চে একটা ছেলে উল্টো দিকে মুখ ফিরে বসে রয়েছে। ছেলেটার চেহারা দেখে নিলয় তক্ষুনি চিনতে পারলো। ঋজু অনেক আগেই চিনতে পেরেছিল। এ আর কেউ নয়, ওদেরই বন্ধু আকুল।
ঋজু বলল, “আকুল তুই একা এখানে বসে আছিস, কি ব্যাপার।”
বেঞ্চে বসতে বসতে নিলয় বলল, “আমরা ভাবলাম তুই আর সুরভী হয়তো নির্জনে অন্য কোথাও আড্ডা দিচ্ছিস। কিন্তু তুই তো দেখছি এখানে।”
আকুল কোনো কথা বলল না। আগের মতোই উল্টো দিকে মুখ ফিরে রইল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ঋজু তার ঘাড়ের কাছে ধরে হালকা টান দিয়ে মুখটা সামনে ঘুরিয়ে দিল। দুজনে দেখল, তাদের চেনা আকুলের সেই পুরোনো উৎফুল্ল মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। দুজনেই অবাক। ঋজু বলল, “কি রে কি হয়েছে ? মুখ শুকনো করে বসে আছিস, কোনো প্রবলেম হয়েছে।”
নিলয় খিক খিক করে হেসে বলল, “নিশ্চই প্রপোজ করেছিল, না বলে দিয়েছে। তাই মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচ হয়ে গেছে।”
“এই তুই চুপ কর তো। সব কথায় ইয়ার্কি।” তারপর আকুল কে সান্ত্বনার সুরে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, না বলেছে তো কি হয়েছে, আর কি মেয়ে নেই নাকি।”
এতক্ষন আকুল চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে বলল, “আরে বাবা ও না বলেনি।”
“তবে।”
মুখ গোমরা করে আকুল বলল, “ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।
আকুলের মুখে এ কথা শোনার পর দুজনেই হা হা হো হো করে দম ফাটা হাসি জুড়ে দিল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে ঋজু বলল, “ওহ্ ওহ্ সরি সরি। বাট তুই কিভাবে জানলি ওর বয়ফ্রেন্ড আছে ?”
আকুলের ভীষণ রাগ হচ্ছিল দুজনের উপর। কথাই বলবে না ওদের সঙ্গে। কিন্তু শেষ অব্দি দুজনে এমন ভাবে রিকোয়েস্ট করলো যে তাকে বলতেই হলো।
“আটটা থেকে সুরভীর অপেক্ষায় বসেছিলাম। দশটা বেজে গেল কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না ওকে। সাড়ে দশটার সময় যখন পুষ্পাঞ্জলি দেবো বলে লাইনে দাঁড়িয়েছি দেখি আমার ঠিক সামনেই সুরভী দাঁড়িয়ে। আমি ওকে দেখে হাত নাড়ালাম, কিন্তু ও দেখেও দেখলো না। অথচ পাশে একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ছেলেটা ওর হাতে জল দিল, ফুল ছিঁড়ে দিল। এসব দেখে আমার তো ভীষণ রাগ হচ্ছিল।
পুষ্পাঞ্জলির পর একটু একা পেয়ে ওকে আড়ালে টেনে আনলাম। জিজ্ঞাসা করলাম ছেলেটার ব্যাপারে। ও বলল, ওর বয়ফ্রেন্ড হয়। কথাটা শুনে মনে হলো কেউ যেন আমার হৃৎপিন্ডে হাতুড়ি মেরে পেরেক পুঁতে দিল।
আমি আর কোনো কথা বলিনি। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে আসি। তারপর থেকেই এখানে বসে আছি।”
“বেশ করেছিস। ওই সব মেয়ে-টেয়ের কথা ছাড়। ওই রকম দু-চারটা ক্রাশ সবার জীবনে থাকে।” ঋজু বলল।
নিলয় খোঁচা দিয়ে বলল, “এমন ভাবে বলছে তার যেন দশ-বিশটা ছিল।”
“হুম্। এত গুলো না হলেও পাঁচ-ছটা মতো তো ছিলই। এবার বিশ্বাস করাটা তোদের ব্যাপার।”
আকুলের মুখ উৎফুল্ল। বলল, “কি বলছিস, জানতাম না তো।”
“এসব কি আর সবাইকে বলা যায়।” ঋজু বলল।
নিলয় বলল, “তা বলে আমাদেরও বলবি না।”
মাঠের উপর দিয়ে ওর তিনজন হাঁটছিল। নিলয়ের ইয়ার্কি আর ঋজুর কথা শুনে আকুলের মনটা ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিল।
ঋজু বলছিল, “আরও শোন, একজন ক্রাশ ছিল যার বয়স আমার চেয়ে পাঁচ বছর বেশি।”
“বল বল ওই ঘটনাটাই বল।”
“পরে কোনো একদিন বলবো। আজকে বাড়ি চল। বিকেলে ক্রিকেট খেলতে আসতে হবে। এক সপ্তাহ পর ইন্টার স্কুল কম্পিটিশান আছে। প্রাকটিস চাই, প্রাকটিস। জিততেই হবে আমাদের।”