এবারে যেন গতবারের চাইতে একটু বেশি ভিড় বলে মনে হচ্ছে। এত ভিড় যে, আমাদের নিজে থেকে চলতে হচ্ছে না। ভিড়ের ঠেলায় অনায়াসেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। রক্তিমের হাতটা ধরা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বুঝি হাতটা ছাড়া হয়ে গেল।
আজ কালী পুজো। সবাই বলে এখানে নাকি কালী পুজোতে বিশাল মেলা বসে আর অনেক দূর দূরান্ত থেকে নাকি লোকজনেরা আসে এখানে পাঁঠা বলি দিতে। যদিও আমার এই সব বলি-টলি মোটেই ভালো লাগে না তবুও পিসির বাড়ি থেকে রক্তিমের নামে মানত করা পাঁঠা বলি দেওয়া হবে জেনে চলে এসেছি। প্রতি বছর আসি কিন্তু এক থেকে দু-ঘণ্টার বেশি থাকা হয় না। তাই এবারে একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে আমি আর রক্তিম ভেবেই নিয়েছি যে সারা রাত মেলাতে ঘুরবো। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে কিন্তু সয়টার পরে আসিনি। গলাতে শুধু একটা মাফলার জড়ানো রয়েছে। আশাকরি ওতেই চলে যাবে।
ভেতরের দিকে যতই ঢুকছি ভিড় তত বাড়ছে। একসময় রক্তিম আর আমার হাতের মধ্যে টান এতটাই বেড়ে গেল যে ওর হাতটা ফস করে ছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু আমিও ছাড়বার পাত্র নই, খপ করে আবার ধরে ফেললাম ওর হাতটা। শুধু ধরলামই না খুব শক্ত করে ধরলাম যাতে আবার ছাড়া না হয়ে যায়।
একটা ব্যাপার আমার খুব অদ্ভুত লাগছে যে, রক্তিম কেন আমার হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে কি ও হাত ধরে চলতে চায় না। না চাক ও, এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যাবো তার ঠিক নেই। আমি আরও শক্ত করে হাতটা ধরলাম। কিন্তু এ কি রক্তিমের হাতটা হঠাৎ এত কোমল হয়ে গেল কি করে। শীতের কারণে কি? হবে হয়তো। ওহ্ রক্তিম আবারও হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু কারণটা কি?
সামনে একটা মোটামুটি ফাঁকা জায়গা রয়েছে। আমি রক্তিম কে সেই দিকে টেনে নিয়ে চললাম। কারণটা আমাকে জানতেই হবে।
ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পেছনে ঘুরেই আমার মাথায় হাত। একি রক্তিম কোথায়? এ তো রক্তিম নয়, তার যায়গায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে। বয়স উনিশ, কুড়ি কি একুশ হবে। ফর্সা গায়ের রং। খোঁপা করে চুল বাঁধা। গোলাপি রঙের চুড়িদার পরা, চয়েস আছে বলতে হবে মেয়ের। অন্য কালারে হয়তো এতটা ভালো লাগতো না।
মেয়েটা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ঢোক গিলে অন্য দিকে তাকানোর ভঙ্গি করতে মেয়েটা রেগে বলে উঠল, “ও Hello ওদিকে কোথায় তাকাচ্ছেন, এদিকে তাকান।”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “ইয়ে মানে, আসলে...।”
আমার কথা পুরো শেষ না হওয়ার আগেই মেয়েটা বলল, “আচ্ছা আপনারা মেলাতে আসেন এই সব করতে নাকি? আমি খুব শান্ত সভাবের মেয়ে বলে কিছু বলছি না। অন্য মেয়ে হলে না এতক্ষনে ঠাঁটিয়ে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিতো।”
“আরে আমার কথাটা তো শুনুন আগে। তখন থেকে আপনি একাই বলে যাচ্ছেন।”
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।
আমি স্থির ভাবে বললাম, “আসলে আমি আমার পিসির ছেলে রক্তিম ভেবে আপনার হাতটা ধরে ফেলেছিলাম। ইচ্ছে করে আমি ধরিনি।”
আমার কথা শুনে মেয়েটা যেন আরও রেগে গেল। বলল, “এ সব অজুহাত গুলো না অন্য কাউকে দেখাবেন। আপনার মতো ছেলেদের কে বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে। অসভ্য বাজে ফালতু ছেলে কোথাকার।”
“অসভ্য নাকি? আমি...আমি অসভ্য ফালতু ছেলে। দেখুন উল্টো পাল্টা কথা একদম বলবেন না ঠিক আছে। মানছি আমার ভুল হয়েছে তবে আপনি যে রকম টি ভাবছেন মোটেও ওরকম আমি নই।”
মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে বলে ফেলল, “সবাই বলে ওরকম।”
একটা কল আসতে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি রক্তিম ফোন করেছে।
বললাম, “আরে কোথায় হাফিস হয়ে গেলি তুই? আমি তো ফেঁসে গেছি...।”
পুরো কথাটা আমি শেষ করতে পারলাম না। অনুভব করলাম মেয়েটার একটা আঙ্গুল আমার আঙ্গুলে স্পর্শ করেছে।
মেয়েটা বলল, “Actually ওতে আপনার কোনো দোষ নেই। আসলে আমার কয়েকজন বান্ধবী...।”
আমি হাত উপর করে মেয়েটাকে কথা বলা । তারপর কয়েকবার মিছিমিছি Hello Hello বলে ফোনটা কেটে দিলাম। বললাম, “হ্যাঁ বলুন কি যেন বলছিলেন।”
“আসলে আপনার মতোই ভিড়ের মধ্যে বান্ধবীর থেকে আমার হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আমিও ভুল করে আপনার হাতটা ধরে ফেলেছিলাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারি যে ওটা আমার বান্ধবী নয় তখন আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আপনি তো ছাড়ছিলেন না।”
আমি হেসে বললাম, “কিন্তু আমি তো তখনও বুঝতে পারিনি যে ওটা একটা মেয়ের হাত।”
মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “ভালোই ফ্যাসাদে পড়লাম, খুঁজবো কিভাবে এবার ওদের। ফোনও নেই কাছে যে ফোন করবো একটা।”
“খুঁজে দেখুন নিশ্চই পেয়ে যাবেন।” আমি বললাম।
“এভাবে একা একা এত ভিড়ের মধ্যে কোনো দিনও পড়িনি। আপনি একটু চলুন না আমার সঙ্গে।”
আমি মাথা কামড়াতে কামড়াতে বললাম, “ইয়ে মানে, আমি।”
মেয়েটা আমার দিকে কড়া দৃষ্টি ফেলে বলল, “নাটক মারাচ্ছেন। আপনার চোখ মুখ দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে যে আপনি যেতে চান।”
আমি অপ্রস্তুতিতে পড়ে গেলাম। মেয়েটা আমার মনের কথা জানলো কি করে। নাকি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে লেগে গেছে। মনে হয় না আন্দাজে, কারণ আমি যেভাবে রিয়েক্ট করছিলাম তাতে একটা বোকার পক্ষেও এটা জানা অসম্ভব কিছু নয়।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “Ok, চলুন। ......আচ্ছা হ্যাঁ, আপনার নামটাই তো জানা হলো না।”
হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েটা বলল, “আমার নাম। আমার নাম সুচিস্মিতা। সুচিস্মিতা রায়। আর আপনার নামটা।”
“অঙ্কুর সেন।”