Subscribe Us

header ads

মাটির নিচে তুমি আমি

বৃষ্টি নেমেছে। অনিকেতের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বৃষ্টিতে ভিজছে, তবুও শ্বেত পাথরে বাঁধানো তনিমার কবর টা কে আঁকড়ে ধরে রয়েছে।

আজ কত দিন যেন হলো? তা প্রায় এক বছর হতে চললো। আর এক দিন পর আগামীকালই ওদের বিবাহ বার্ষিকী। সে কথা অনিকেত ভুলে যায় নি। আজকের সারা রাতটা তনিমার কাছে থাকতে চায় অনিকেত। কাল সকালে তনিমার কবর টা কে ফুল দিয়ে সাজাবে যত্ন করে। তারপর সারাদিন তনিমার সঙ্গে কথা বলবে অনিকেত। বৃষ্টি পড়া বাড়লো। অনিকেত তনিমার কবর টা তে একটা চুম্বন করে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কবর টা কে।

আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে তনিমা কে বিয়ে করেছিল অনিকেত। না, কোনো Love Marriage নয়, দেখাশোনা করে। কিন্তু বিয়ের পর, বিয়ের পর অনিকেত ভীষণ ভালো বেসে ফেলে তনিমা কে। তনিমা ও অনিকেত কে খুব ভালো বাসতো।

বিবাহিত জীবন ভালোই কাটছিল ওদের। আঘাত টা এল অন্য দিক থেকে।

একদিন সকালে অনিকেত তনিমা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ একটা লরিকে ক্রস করতে গিয়ে Balance হারিয়ে বাইক সহ দুজনে ছিটকে গিয়ে পড়ে লরির সামনে। অনিকেতের আঘাত সামান্য হলেও তনিমা গুরুতর ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়। দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর অনিকেত বেঁচে গেলেও তনিমাকে বাঁচানো যায়নি। জ্ঞান ফেরার পর অনিকেত যখন জানতে পারে তনিমা আর বেঁচে নেই, তখন ও পাগলের মতো হয়ে যায়।

তারপর থেকে প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় কবরের পাশে এসে বসত অনিকেত। বন্ধুরা আবার বিয়ে করার কথা বলেছিল অনিকেত কে। কিন্তু অনিকেত কোনো গায় করেনি। প্রতিদিন একটা করে শিউলি ফুল ওর কবরের উপর রাখতো। শিউলি ফুল যে তনিমার ভীষণ প্রিয় ছিল। বছরের সব সময় তো আর শিউলি ফুল পাওয়া যায় না। তাই আগে থাকতে অনেক শিউলি ফুল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রেখেছিল অনিকেত, শুধু মাত্র তনিমার জন্য।

দিন যেতে থাকে, সপ্তাহ যেতে থাকে, মাস যেতে থাকে। অনিকেত আগের চাইতে আরও বেশি সময় ধরে বসে থাকে কবরের কাছে।

শরীরের হাল বেহাল হয়েছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না, ঘুমায় না, সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। লোকে দেখে পাগল ভাবে। কিন্তু তাতে তার কোনো যায় আসে না।

মাঝে মাঝে বাড়িতে যায় কিছু খবার নিয়ে এসে তনিমার কাছে বসে খেতে থাকে। কবরের উপর খাবার রেখে বলে, “খেয়ে নাও। কাল থেকে কিছুই খাওনি, খিদে পেয়েছে নিশ্চই।”

নিজের খাওয়া শেষ হওয়ার পর যখন দেখে কিছুক্ষন আগে দেওয়া খাওয়ার টা সেই রকমই পড়ে রয়েছে তখন অনিকেত মুখ শুকনো করে বলে, “তুমি বুঝি আমার উপর রেগে আছো? খেয়ে নাও Please, না খেলে যে শরীর খারাপ করবে। ও বুঝেছি আমি নিজের হাতে না খাইয়ে দিলে তুমি খাবে না তাই তো।”

অনিকেতের এই সব কথবার্তা শুনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েরাও হাসা হাসি করে।

এই ভাবেই এক বছর কেটে গেল। নিজের শরীরের দিকে কোনো খেয়াল না দিয়ে দিয়ে মুখে বনমানুষের মতো দাঁড়ির জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে। না খেয়ে খেয়ে শরীরটা শুকিয়ে শুঁটকি মাছের মতো হয়ে গেছে।

রাত আরও গভীর হলো। বৃষ্টির দাপট আর আর ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজ পড়ছে। তার উজ্জ্বল নীলচে আলোয় মাঝে মধ্যে একবার করে কবর টা কে দুর্বল চোখ দিয়ে দেখছে অনিকেত। এমন সময় বজ্রপাতের উজ্জ্বল আলো ওর চোখ দুটোকে ঝলসে দিল। তারপর সেই কান ফাটানো শব্দে নেমে এলো ভয়ঙ্কর মৃত্যু দূত।

পরদিন সকালে তনিমার কবরের পাশে আর একটা কবর খোঁড়া হলো। তারপর সেই কবরে শুইয়ে দেওয়া হলো অনিকেত কে।

সব কিছু কাজ মিটে যাওয়ার পর যখন সবাই চলে গেল, কবর স্থান তখন একদম শুনসান। অনিকেত আর তনিমা পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে মাটির নিচে।

অনিকেত তনিমাকে বলছে, “এবার আর কেউ আমাদের কে আলাদা করতে পারবে না। যুগ যুগ ধরে আমি এইভাবেই তোমার কাছে থাকবো।”

এতদিন পর অনিকেত তনিমার কথা শুনতে পেল। তনিমা বলছে, “হ্যাঁ, এই ভাবেই পাশাপাশি মাটির নিচে তুমি আমি।”