বাড়ীতে পুজোর ছুটি কাটিয়ে মেসে ফিরবো বলে ট্রেনে তো উঠে পড়লাম কিন্তু সিট পাবো কি না সেটাই ভাবছি। প্রথমে একটা কামরাতে উঠে দেখি পুরোপুরি ভর্তি, বসবার একটা জায়গাও ফাঁকা নেই। দ্বিতীয় কামরাতে গেলাম। হ্যাঁ একটা সিট ফাঁকা আছে বটে। কেউ বসে পড়বার আগেই ফট করে গিয়ে বসে পড়লাম সিট টা তে।
সস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। এই ট্রেনে এই সময়ে বসবার জায়গা পাওয়া ভীষণ মুশকিল।
যাক গে, সিট পেয়ে গেছি কোনো আর কোনো চিন্তা নেই। দু ঘণ্টার পথ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটে যাবে। কিন্তু জানালা ধারের সিট টা পেলে ভালো হতো। কথাটা ভেবে আমি জানালার দিকে তাকালাম। আর তাকিয়েই আমার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেখি হলুদ আর তার সঙ্গে হালকা লাল মেশানো রঙের চুড়িদার পরিহিত একটা মেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। কোলের উপর রাখা একটা ছোটো ব্যাগ। তার উপর লাল রঙের চুড়ির ভেতর দিয়ে গলানো হাত দুটোর মাঝে একটা মোবাইল ফোন। ভাবলাম, দু ঘন্টা যে ঘুমাবো ভেবেছিলাম সেটা আর বোধ হয় হলো না।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। মাঝে যে কতবার মেয়েটার দিকে তাকিয়েছি তার হিসেব নেই। অনেকবার তার চোখের দিকে তাকিয়েছি। তার চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলছি। পাগলা হওয়ায় মুখের উপর উড়ে আসা চুলের বর্ণনা দিতে আমি পারছি না। এক কথায় মনমুগ্ধকর।
লোকজন দেখলে খারাপ ভাবতে পারে তাই সব সময় তাকিয়ে থাকা যায় না। তবুও মাঝে মধ্যেই আড় চোখে দেখছি।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। আমার সামনে যে মাঝ বয়সী ভদ্র লোক বসে রয়েছেন তিনি বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছেন। কেননা দু বার তিনি আমার দিকে আশ্চর্য্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। সে করুক গে, আমি নির্লজ্জের মতো তাকিয়েই থাকলাম মেয়েটার দিকে।
একসময় আমার যেন কি হলো মনে মনে ভাবলাম মোবাইলটা বের করে একটা ছবি তুললে কেমন হয়। অবশ্য সে কাজটা লুকিয়ে করতে হবে, না হলে সবাই মিলে মেরে আমার ছাল চামড়া খুলে নেবে।
আমি আস্তে আস্তে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। তারপর একটু আড়াল করে রাখলাম মোবাইলটা, যাতে কেউ না বুঝতে পারে ছবি তুলছি বলে। ক্যামেরাটা অন করলাম। ক্যামেরার পজিশান ঠিক আছে কিনা কিংবা কোনো কিছু আড়াল করে রেখেছে কিনা কিছুই বোঝার উপায় নেই। তবুও একটা ক্লিক করলাম। এক সেকেন্ডের জন্য একটা উজ্জ্বল আলোর চমক। তারপর দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একমনকি সেই মেয়েটাও। আমিও অবাক। তাড়াতাড়ি মোবাইলটা চোখের সামনে নিয়ে এসে মোবাইল স্ক্রিনের দৃষ্টি দিলাম। আর তখনি যেন মাথায় বাজ পড়লো। একি! ক্যামেরার ফ্ল্যাশ অন করা ছিল। আর সেই কারণেই তখন আলো জ্বলছিল। ওহ্ কি গাধা আমি, ফ্ল্যাশ টা কেন অফ করে দিই নি ছবি তোলার আগে।
সবাই আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ভাবলাম এবার বোধহয় মার পড়বে। এক্ষুনি চম্পট দিতে হবে এখান থেকে। যেই মতো ভাবা সেই মতো কাজ। আমি ব্যাগটা টেনে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এলাম ট্রেনের দরজার সামনে। দেখি ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেছে। এবার নেমে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। আর নেমেই স্টেশন থেকে শিগগির অদৃশ্য হতে হবে।
ট্রেন থামতেই তড়িঘড়ি নেমে পড়লাম। তারপর একটু দূরে এগিয়ে গিয়েছি হঠাৎ এক পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে এল।
“ম্যাডাম কেমন আছেন?”
পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রেনের জানালা ধারে বসা সেই মেয়েটা। আমার দিকে পেছন ঘুরে রয়েছে। আর মেয়েটার সামনে ট্রেনের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার স্কুলের এক বন্ধু সন্দীপন। সন্দীপন আমাদের কলেজেই পড়ে। নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু হঠাৎ সন্দীপন এই মেয়েটাকে ম্যাডাম বলে কেন সম্বোধন করলো? কি জানি হয়তো চেনা জানা কেউ সেই কারণে ইয়ার্কি করে বলেছে।
“হ্যাঁ ভালো।” মেয়েটা বলল।
তারপর সন্দীপন হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে বলল, “আরে অঙ্কু তুইও যে আজকে আসছিস একবার ফোন করে তো বলতে পারতিস তাহলে একসঙ্গেই চলে আসতাম।”
এবার দেখি সন্দীপনের কথা শুনে মেয়েটা আমার দিকে ফিরে তাকালো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি চোখাচুখি না করে প্রথমে নিচের দিকে তারপর স্টেশনে আর একটা ট্রেন আসতে ওদিকে তাকালাম।
এক মুহুর্ত পর যখন আমি মেয়েটার দিকে ফিরে তাকালাম, দেখলাম মেয়েটা সন্দীপনের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছে, “ও আমাদের কলেজে পড়ে?”
সন্দীপন আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, “হ্যাঁ আমাদের কলেজেই তো। বাংলা ডিপার্টমেন্ট।”
আমরা যে ট্রেনটা তে এসেছিলাম সেটা পরের স্টেশনে যাবে বলে চলতে আরম্ভ করলো। মেয়েটা “আচ্ছা” বলে আমার কাছ দিয়ে স্টেশনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর যাওয়ার সময় আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে গেল।
ওদিকে মেয়েটাও স্টেশনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল আর এদিকে ট্রেনটাও স্টেশন ছাড়লো। প্লাটফর্মে আর ভিড় নেই, দু চারজন এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করছে কিংবা প্ল্যাটফর্মের ব্রেঞ্চ গুলোতে বসে রয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ সন্দীপনের কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওই মেয়েটা কি তোদের সঙ্গে পড়ে?”
সন্দীপন বিস্তর হেসে বলল, “আরে ধুর আমাদের সঙ্গে কেন পড়তে যাবেন। উনি তো আমাদের নিউট্রেশানের ম্যাডাম। পুজোর আগে নতুন এসেছেন কলেজে। আমাদের সঙ্গে পড়ে না, বরং আমাদের কে পড়ান।”
“আ্যঁ” আমার মাথায় হাত।
সেদিন
বুঝেছিলাম যে মেয়েদেরকে দেখে তাদের সঠিক বয়স কখনো ধারণা করা যায় না।