সেদিন আমার
এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সম্পর্কে ওনারা
আমার দাদু দিদা হন। মানে সহজ করে
বলতে গেলে আমার দিদার ছোটো বোনের বাড়ি। তাদের কোনো
ছেলে মেয়ে নেই। স্বামী
স্ত্রী দুজনে মিলে একটা
ছোটো মাটির বাড়ীতে থাকেন। বাড়িটা গ্রামের
একেবারে এক প্রান্তে অবস্থিত। ছোটো খাটো
একটা জঙ্গলের ভেতর থেকে একখানি সরু মোরামের রাস্তা ওনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গ্রামের
ভেতরে চলে গেছে। সেই রাস্তার
দুই পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকখানি পাকা ও মাটির বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়িতে এখন আত্মীয়
স্বজন ও কুটুম্বদের ভিড়ে মুখরিত। বছরের এই সময়টাতেই
গ্রামের পুজো আর মহোৎসব উপলক্ষে সকলের বাড়িতে ভিড় ভাট্টা প্রায় লেগেই থাকে।
কথাবার্তার
ফাঁকে কখন যে চুপি চুপি করে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে সেটা খেয়াল করিনি। যখন এসেছিলাম তখন সবে মাত্র সূর্য ডুবি
ডুবি করছিল। এসেই দুই বোনের
খোশমেজাজে গল্প শুরু হয়ে গেল। আমি খাটের
উপর বসে চুপচাপ তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। এনাদের বাড়িতে কুটুম বলতে কেবল আমি আর আমার দিদা।
আমাদের আসার
পর দাদু জানিনা কোথায় গিয়েছিল। এখন ফিরে এসে
আমাদেরকে একই ভাবে বসে থাকতে দেখে দিদার উদ্দেশে বলল,“আরে তুমি ওদেরকে
এখনো বসিয়ে রেখেছো। একটু পরে যাত্রাপালা
গান শুরু হবে, খাওয়া
দাওয়া টা তো আগে থেকে সেরে রাখবে নাকি!”
তখন থেকে
একাধিকবার মাইকে যাত্রা পালা গানের কথা সম্প্রচার করতে শুনেছি। একটু পরে যাত্রাপালা গান শুরু হবে। আপনারা সবাই গুটি গুটি পায়ে চলে আসুন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন খেতে বসেছি মাইকে সেই একই রকম সম্প্রচার
শুনতে পেলাম। হয়তো কিছুক্ষন
পরেই শুরু হবে যাত্রাপালা গান।
মাংসতে আমার
চিরকালই অরুচি। তাই আর পুরো
বাটিটার দিকে ভালো করে নজর দিলাম না।
সমস্ত
আতিথিয়তা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরবো বলে সাইকেলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, তখন দেখি
রাস্তা দিয়ে দলে দলে লোকজন যাত্রা পালা গান শুনতে যাওয়ায় ব্যস্ত।
দিদা আজকে
এখানেই থাকবে। যাত্রা শুনতেও যাবে হয়তো। আমাকে একাই
বাড়ি ফিরতে হবে। সন্ধ্যে হয়েছে অনেকক্ষণ হল। একটু পরে রাত নামতে শুরু করবে। তাই
আর বেশি দেরি করবো না ভেবে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা যেই তুলেছি ঠিক তখনি দেখি দিদা
কিছু একটা ভর্তি ব্যাগ আমার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিল। আমি দিদার
মুখের দিকে তাকাতে দিদা বলল, “তুই আর তোর
দিদা তো এখানেই খেয়ে নিলি আর এটা দিলাম তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তোর মা, বাবা,
দাদু বাড়িতে রয়েছে। আশা করি যা
ভাত, তরকারি আর মাংস দিয়েছি ওতেই হয়ে যাবে তিনজনের। মিছিমিছি তিন
জনের জন্য আর রান্না করতে হবে না।”
রাস্তা তখন
শুনশান। আমি
দুদিকের ঘন জঙ্গল কে পেছনে ফেলে সরু রাস্তা দিয়ে একাকি সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছি। যাত্রা ততক্ষনে
শুরু হয়ে গিয়েছে। দূর থেকে সে
শব্দ কানে ভেসে আসছে।
নির্জন
জঙ্গলের মধ্যে যেতে যেতে গা টা একটু ছমছম করছিল। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মধ্যেই পেঁচার
ডাক কানে আসতে লাগলো। পূর্ণিমার
রাত। সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে ছিটে ছিটে আলোর উজ্জ্বল
রেখা চারিদিক টা কে যেন আরও মায়াবি করে তুলেছে।
প্রায় আধ
মাইল লম্বা এই নির্জন জঙ্গলের রাস্তা পেরোলে পিচের রাস্তার দেখা পাওয়া যাবে। আশাকরি রাস্তাতে
লোকজনের অভাব হবে না। মনের মধ্যে
একটু একটু করে ভয়ের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিচের
রাস্তাতে পৌঁছাতে হবে ভেবে আমি সাইকেলের বেগ বাড়ালাম।
অনেকক্ষণ
থেকেই টের পাচ্ছি ব্যাপারটা। খানিক আগে
থেকেই আমার সারা শরীরটাতে কেন জানি না ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। পরে পরে সেই
ঠান্ডার মাত্রা বাড়ছে বইকি কমছে না। বিশেষ করে
কোমরের দুদিকে ঠান্ডার মাত্রাটা অত্যাধিক পরিমাণে বেশি। মনে হলো কেউ
যেন তার বরফ ঠাণ্ডা হাত দুটোকে কোমরের উপর চেপে বসিয়ে দিয়েছে।
যদিও এটা ফাল্গুনের
শুরু। ঠাণ্ডার মাত্রা
এতটাও নয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে গায়ে একটা সয়টার জড়ানো থাকলে বোধ হয় এই
ঠাণ্ডা থেকে একটু নিষ্কৃতি পাওয়া যেত।
শীতকাল নয়,
বৃষ্টিও হয়নি কিংবা ঠাণ্ডা হাওয়াও বইছে না। তবে এমন ঠাণ্ডা লাগার কারণ কি হতে
পারে? তবে কি আমার জ্বর এলো নাকি?
জ্বর এসছে
কিনা পরীক্ষা করার জন্য বাম হাতের তেলো টা আমি আমার গলায় ছোঁয়ালাম। ঠিক তখনি নাকে
একটা গন্ধ এলো, রান্না করা মাংসের গন্ধ।
মাংসের
গন্ধ কোথা থেকে এলো?
এমন একটা বোকা
বোকা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসতে নিজেকে গাধা বলতে ইচ্ছে হলো। টিফিনে করে মাংস নিয়ে যাচ্ছি। গন্ধ হওয়া টা তো স্বাভাবিক। আমি নিজেই
নিজের মাথায় আলতো চাপড় দিলাম।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ
মনের মধ্যে আবার একটা প্রশ্নের উদয় হলো। এতক্ষন তো মাংসের গন্ধ ছিল না। তবে এখন কেন
আসছে? তাও আবার খুব কড়া গন্ধ। ঠিক এমনটা, কেউ কাছে বসে
মাংস খেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনটি।
আমি তাড়াতাড়ি
টর্চ টা সাইকেলে ঝোলানো ব্যাগটার ভেতর ফেললাম। দেখলাম
টিফিন ক্যারিয়ারের ঢাকনা টা যেভাবে লাগানো ছিল সেইভাবেই লাগানো রয়েছে। তবে কি
সবটা আমার মনের ভুল?
যাক গে, ঠান্ডার
মাত্রাটা অনেকটা কমেছে। আমি টর্চটা
কে আবার রাস্তার দিকে ফেরালাম।
পিচের
রাস্তাতে লোকজনের চলাচল ছিল। রাস্তার দুদিকে ছড়িয়ে থাকা দোকান গুলোতে আলো জ্বলতে
দেখে বুঝলাম এখনো ওগুলো বন্ধ হয়ে যায়নি। ফাঁকা মসৃণ রাস্তা। বেশি গাড়ি-ঘোড়া তেমন
নেই। তাই সাইকেল টা কে জোরে ছুটিয়ে দিলাম।
এক মাইল রাস্তা
কখন যে পেরিয়ে চলে এলাম, কখন যে নিজের গ্রামের রাস্তায় ঢুকে গেলাম বুঝতেই পারিনি। যখন দেখলাম
যে চারিদিকে অন্ধকার এবার টর্চ জ্বালাতে হবে তখন বুঝতে পারলাম যে এতটা রাস্তা চলে এসেছি।
এদিকের আধ
মাইল রাস্তার পুরোটাই মাটির। বেশি
চওড়া ও নয়। একসঙ্গে লম্বা-লম্বি তিন
জন যেতে পারে না।
রাস্তায়
যেতে যেতে এক যায়গায় প্রকাণ্ড একখানি বট গাছ চোখে পড়ে। যার থেকে একটু
দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে গ্রামের শ্মশান।
মনে মনে ভেবে
নিলাম ওই জায়গায় পৌঁছালে রামনাম জপতে জপতে জোর সাইকেল ছোটাবো।
আর করলাম ও
ঠিক তাই। বট গাছটা থেকে যখন প্রায় হাত পঞ্চাশেক দুরে রয়েছি পায়ের পেশি গুলো এমনিতেই
শক্ত হয়ে উঠল। জোর চাপ দিলাম
সাইকেলের প্যাডেলে।
যখন বট গাছটার
তলায় পৌছালাম তখন সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। এমনটা হওয়ার
কারণ শুধু মাত্র ভয় ছিল না, ছিল আরও অন্য কিছু। সেটা আর
কিছুই নয়, আগের সেই কনকনে ঠাণ্ডা ভাবটা। সেই রকমই কোমরের
কাছে ঠান্ডার মাত্রা টা অত্যাধিক পরিমাণে বেশি। মনে হচ্ছে
যেন ঠান্ডায় দুদিকের কিডনি দুটো জমে বরফ হয়ে যাবে। যেন কেউ বরফ শীতল হাত দিয়ে কিডনি দুটোকে
মুঠো করে ধরে রেখেছে।
আমি বাম
হাতটা কোমরের উপর ঠেকালাম। সঙ্গে
সঙ্গে হাতটাও যেন কনকনে ঠান্ডায় অবশ হয়ে গেল। আর সেই
সঙ্গে রান্না করা মাংসের গন্ধ নাকে আসতে লাগলো।
এটা পুরোপুরি
সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রথমে শীতল
ভাব তারপর মাংসের গন্ধ।
আমি আগের
মতো টর্চ ফেলে দেখলাম টিফিনের ঢাকনা টা আগের মতোই লাগানো রয়েছে। তবে এত কড়া
মাংসের গন্ধ কোথা থেকে আসছে ? উফ্, কি যে
হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
বাড়ির প্রায়
কাছাকাছি চলে এসেছি। ঠাণ্ডা ভাবটা
প্রায় নেই বললেই চলে।
বাড়িতে পৌঁছে
সাইকেলের হাতল থেকে ব্যাগটা বের করে মায়ের হাতে দিলাম। মা রাতের খাবার তৈরি করতে
রান্না ঘরে ঢুকেছিল। ভাগ্যিস সময়
মতো এসে পৌঁছেছিলাম, তা না হলে মা হয়তো এতক্ষনে রান্না বসিয়ে দিত।
আমি
টিউবওয়েলে হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসে গামছা দিয়ে মুখ মুছছিলাম। সেই সময় মা
হঠাৎ রান্না ঘর থেকে হাঁক ডাক শুরু করলো।
গিয়ে দেখি,
মা হাতে খোলা টিফিন ক্যারিয়ার টা নিয়ে গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বললাম, “কী হয়েছে
বলো।”
মা টিফিন
ক্যারিয়ার টাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোর দিদা আমাদের
তিন জনের জন্য এই একটা মাংসের টুকরো দিয়েছে নাকি।”
“একটা
মাংসের টুকরো মানে!” আমি টিফিনের ভেতরটাতে চোখ চারিয়ে দেখলাম
সত্যি একটা মাংসের টুকরো টিফিনের এক দিকে পড়ে রয়েছে। অবাক বিস্ময়ে
বললাম, “সত্যি তো একটা মাংসের টুকরো দিলো নাকি
দিদা।”
“দিদা একটা
মাংসের টুকরো দিয়েছে, নাকি নিজেই মাঝ রাস্তায় সব গুলো খেয়ে ফেলেছিস।”
“আমি! আমি
কেন খেতে যাবো। তুমি তো জানো আমি মাংস কম খাই। এমন কি ওখানেও কম খেয়েছি।”
আমার কথা
শেষ হওয়ার আগেই মা ওই এক টুকরো মাংস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই একটা
টুকরো আর কেন পড়ে থাকবে। নে খেয়ে নে।
যাক গে রান্না বসাই, খেতে তো হবে।” বলে মা রান্না
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনটা খারাপ
হয়ে গেল। এক দৃষ্টে
মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আবার ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে।
খানিক পরে
মা ফিরে এসে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “বাহ্, এর মধ্যে খাওয়া
ও হয়ে গেল।”
আমি অবাক
হয়ে হাতের দিকে তাকালাম। অবাক
কান্ড মাংসের টুকরো টা গেল কোথায়। আমি তড়িঘড়ি বললাম, “আমি…আমি খাইনি। সত্যি
বলছি আমি মাংসটা খাইনি।”
মা আর কিছু
বলল না। শুধু একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে ঢুকে গেল।
আমি
চিন্তিত মনে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি তখন শুনতে পেলাম কেউ যেন খনা গলায় বলছে, “উঁফ্ মাঁংস গুঁলো খুঁব সুঁস্বাদু ছিঁল।”