পরের দিন সকালেই ব্যাপারখানা সবাই বুঝতে পারলো। যেন আষাঢ়ের কালো মেঘ থেকে বেরিয়ে আসা এক
টুকরো আলোর রশ্মি ভেদ করে গেল সকলের মস্তিষ্ককে। সুশান্ত ওঝাকে খবর দিতে গেল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওঝা নিশিকান্ত বাবুর বাড়িতে
হাজির হলো। ওঝা এসে প্রথমেই লক্ষ্য করলেন সুজয়ের চোখ
দুটিকে। অসম্ভব ভয়ংকরই দেখাচ্ছিল চোখ গুলিকে। প্রেতপুরীর অদীপ্ত শিখার মতো তার চোখ থেকে সে
এক ভয়ানক জ্যোতি ঠিকরে পড়ছিল। উস্কোখুস্কো চুল গুলো তার নাক পর্যন্ত ঝুলে পড়ায়
সেই জ্যোতি কিছুটা বাধা পাচ্ছিল।
গম্ভীরভাবে ওঝা তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন,- “কবে থেকে এই শরীরে বাঁসা বেঁধেছিস?” কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। তখন ওঝা দ্বিতীয়বার ওই একই প্রশ্নই করলেন। উত্তরে এক তীক্ষ্ণ কর্কশ কন্ঠ সকলের কর্ণকুহরে
শীতল বরফের মত ছ্যাঁকা দিতে লাগলো, “তোকে বলবো কেন রে?”
ওঝা ততক্ষণে তার মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছে। হিং-টিং-ছট…। তার আর মানে উদ্ধার করে কাজ নেই।এদিকে সুজয়ের ভূতটা গা নাড়া দিয়ে উঠলো। মন্ত্রের চোটে ভুতের মুখ দিয়ে রাম-নাম বেরোতে লাগলো। ওঝা বললেন, “আগে বল তুই কে?”
ভূত সুজয়, মানুষের মুখ দিয়ে বলল, “আমি সুজয়।“
ওঝা বললেন, “তা তো বুঝলাম, কিন্তু এরকম কি করে হলো?”
সুজয় মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আমি সুজয় তা আমি আগেই বলেছি, কিন্তু আমার সঙ্গে যা ঘটেছে তা খুবই
মর্মান্তিক।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুজয় আবার বলতে লাগল।
“কাল
বিকেলের পাঠশালা ছুটি হওয়ার পর আমি সুশান্ত আর সুমন আর একটা পাঠশালার উদ্দেশ্যে
রওনা হয়েছি। মাথার উপর কালো মেঘ তখন সবেমাত্র জমতে শুরু
করেছে,
আর
তারই ফলে চারিদিকে আলো-আবছায়া অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আমরা তাড়াতাড়ি মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে
উপস্থিত হই;
তখন সবে মাত্র অন্ধকার হয়েছে, কিন্তু বৈশাখী মেঘ সেই অন্ধকারকে কালিমালিপ্ত
করে আরো ঘন থেকে ঘনতর করে তুলেছে। সঙ্গে দু-চার ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।
তখন আমরা অংক করছি। হঠাৎ লোডশেডিংয়ে বাড়ির আলো ঝপ করে নিভে গেল। আর শুরু হলো ভয়ানক দত্যি-দানবের তাণ্ডব। কালবৈশাখীর শীতল প্রশান্ত হওয়া সকলের শরীরে
কাঁটার মতো বিঁধছিল।
রাত তখন কত হবে, ওই সাড়ে-সাতটা কিংবা আটটা। কিন্তু এর মধ্যেই, বাড়ি ফেরার আশঙ্কা নিয়ে দু-তিনবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে গেছে। তাই শেষ দু-একটা অংক করেই যেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবো; ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচন্ড শব্দে কাছে কোথায়
একটা বাজ পড়ল। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারিদিকটা আলোকিত হয়ে
উঠলো। দিগন্ত বিস্তৃত সেই আলোর ঝলকানি দেখে শিউরে উঠলাম।
সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছি তখন। রাত্রির সেই এত ঘন অন্ধকার হওয়া সত্ত্বেও,আমাদের টর্চ জ্বালানোর কোন প্রয়োজন হলো না। ভয়ঙ্কর বিদ্যুতের আলোই আমাদের পথ দেখাচ্ছিল।
এতক্ষণ সবাই চুপচাপই ছিল। সুশান্ত একটু উত্তেজিত হয়েই বলে উঠলো, “আরে, তাড়াতাড়ি চল। ঝড় জোরালো হলে কিন্তু আর বাড়ি পৌঁছাতে হবে
না।“
তার কথায় সায় দিয়ে সুমন বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক কথা, তাড়াতাড়ি চল।“
আমরা সাইকেলের বেগ বাড়ালাম। কিন্তু পরক্ষনেই সুশান্তের কথাটাই অপ্রত্যাশিত
ভাবে ঘটলো। দুরন্ত কালবৈশাখী তখন গর্জে উঠেছে উন্মত্ত
দানবের মতো।
রাত পৌনে-নটা। আমরা তখন চলেছি একটা বিশাল পুকুরের পাশ দিয়ে। কৃষ্ণাদ্বাদশীর এক ফালি চাঁদ তার রূপ-সৌন্দর্য প্রকাশে কেবলই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কাল
বৈশাখী মেঘের আড়ালে থেকে। বৃষ্টি পড়া তখন কিছুটা বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ঝড়ের দাপট যেন আরো বেড়ে উঠেছে। দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে হু-হুঁ করে তীব্রবেগে বাতাস বয়ে চলেছে। আর সেই বাতাস ওই বিশাল পুকুরের উপর দিয়ে এসে
রক্তমাংসে গড়া আমাদের দেহে শীতলতার শিহরণ জাগিয়ে তুলছে।
ঝড়ের আসল রূপটা বুঝতে পারি এই পুকুরের কাছে এসে। ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে যেন রাক্ষসের দল নৃত্য
করতে করতে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। আর তাদের নৃত্যে পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ গুলি
বিশালাকৃতি আকার ধারণ করে আছড়ে পড়ছে পুকুরের পাড়ে। জীর্ণ, দীর্ঘাকৃতি গাছগুলি তাদের হুংকারে মাথা নুইয়ে
যেন ধরিত্রীকে প্রণাম করছে। আমাদের উপর দিয়ে ধুলোর ব্লিজার্ড বয়ে গেল।
আরেকটু হলেই আমি রাস্তার ধারে পড়ে যেতাম যদি না সুমন আমাকে ধরতো। বহু কষ্টে সেই পিশাচের রাজ্য থেকে বেরিয়ে
এলাম।
এদিকে রাস্তার উপর অম্র বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি একটা আম কুড়াবো এমন সময় সুশান্ত বলে উঠল, “ওহ্, আগে প্রাণটা নিয়ে বাড়ি চল, তারপর না হয় যত পারিস আম কুড়াবি।“
মেঘটা আরো ঘন ভাবে জমতে শুরু করেছে। আর চাঁদের ক্ষীণ আলো দেখা যায় না। চারিদিকে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। আমি সবার পেছনে ছিলাম। হঠাৎ;এক পলকের জন্য বিদ্যুতের চমক।
সুশান্ত চিৎকার করে বলে উঠল, “সুজয় বিদ্যুতের লাইন ছিঁড়ে পড়ছে একটু
সাবধানে।”কিন্তু ততক্ষণে আমি আষ্ঠেপিষ্ঠে জড়িয়ে গেছি
বিদ্যুতের লাইনের সঙ্গে। তারপর সজোরে একটা আছাড়।
প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল দেহ থেকে।”
এতটা বলার পর সুজয় চুপ করলো। কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই চুপচাপ। নিস্তব্ধতাকে ঠেলে আমি বললাম, “তাহলে সুজয় তুই যে আমাদের সঙ্গে এসেছিলি।”
সুজয় আর কিছু বলল না ঠিকই, কিন্তু কেন এসেছিল সেটা আর বুঝতে আমার বাকি
রইল না।
Friendship
কথাটা কানে কানে কেউ যেন বলে গেল।